রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


সাপাহার ঐতিহ্যবাহী জবাই বিলে পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে অভয় আশ্রম


প্রকাশিত:
১৩ জানুয়ারী ২০২১ ০৩:১৩

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:১৩

 পরিযায়ী পাখি

নওগাঁর সাপাহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে শীতের শুরুতেই পরিযায়ী পাখীর আগমন ও বিচরণ শুরু হলেও মৎস্য শিকারীদের অবাধ বিচরণ ও ইঞ্জিন চালিত নৌকার বিকট শব্দের কারনে পাখিগুলি বিল থেকে আবারও ফিরে যাচ্ছে।

বিল এলাকার বাসিন্দাদের মতে উত্তরে ভারত বর্ষের দক্ষিন দিনাজপুর জেলা, দক্ষিনে চাঁপাই নবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী ও পুর্নভবা নদী এবং পূর্ব ও পশ্চিমে সাপাহার উপজেলাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে বয়ে যাওয়া দিগন্ত ছোঁয়া এই বিলে অতিতে প্রতি শীত মৌসুমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সহ সুদুর সাইবেরিয়া হতে হাজারো অতিথি পাখীর আনাগোনায় মুখরিত হয়ে থাকত পুরো বিল এলাকা।

জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা এ বিলে সেসময় পাখী শিকারে তেমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি রাজধানী ঢাকা শহর হতে সাহেবরা এসে পাখী শিকার করত এই বিলে। সেসময় সারা বিল জুড়ে ছিল অসংখ্য কচুরী পানা বিলের অধিকাংশ এলাকায় পানির দেখা মিলত না। সারা বছরে খরা মৌসুমে একবার বিলে মাছ ধরা হত, সেসময় ২০কেজি ৩০কেজি এমনকি এক দেড়মন ওজনের শৌল, বোয়াল কাতলা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়তো জেলেদের জালে।

দেশ স্বাধীনের পর পর মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাল যার জলা তার নিতী ঘোষনা করায় এলাকার কিছু সংখ্যক অসাধু স্বার্থন্বেষী মানুষ বিলটিকে আবাদি জমিতে পরিণত করার উপায় অবলম্বন করে বিল থেকে সমস্ত কচুরীপানা অপসারণ করে ফেলে বিলটিকে মৎস্যশূন্য ও আবাদি জমিতে পরিণত করেন। এর পর থেকে বিলে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য মাছ ধরা পড়তনা জেলেদের জালে এবং প্রতিবছর শীত কালে পরিযায়ী বা অতিথি পাখিরাও আসা বন্ধ করে ওই বিলে।

এর পর এলাকার অভিজ্ঞ মহল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গরা জানান গত ১৯৯৬ সালের দিকে তৎকালিন ও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এক সরকারী সফরে সাপাহারে এলে পুরো বিলটিকে একটি মৎস্য প্রকল্পের অধিনে এনে এলাকার প্রকৃত মৎস্যজিবীদের ভাগ্য উন্নয়নে একটি বৃহত প্রকল্পের ঘোষনা দেন। সে থেকে বিল পাড়ের প্রকৃত মৎস্যজিবীদের নিয়ে একটি সমিতি তৈরী করে তার সকল সদস্যরা বেলটি দেখা শুনার করে সেখান থেকে মৎস্য আহরণ করে তাদের জিবীকা নির্বাহ করে আসছে।

দেশে মৎস্য ও কৃষির আধুনিকায়নের ফলে মাঝের কয়েক বছর ধরে বিলটি প্রায় মৎস্য ও পাখি শূন্য হয়ে পড়ে। গত ২০০৮ সালের দিকে ওই বিল এলাকার উজ্জ্বিতি যুবক সোহানুর রহমান সবুজ এলাকার বেশ কিছু উজ্জ্বিবিত যুবকদের নিয়ে জবই বিল জীব বৈচিত্র সংরক্ষন ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন।

পরবর্তীতে তারা তৎকালীন এমপি ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী বাবু সাধন চন্দ্র মজুমদার, উপজেলা প্রশাসন ও বন্যপ্রাণী ব্যাবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহীর সহায়তায় জেলে ও স্থানীয়দের নিয়ে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, প্রচারের ব্যাবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিলের অতিথি পাখীদের আগমন ঘটা ও তাদের আশ্রয়ের জন্য বিলের বিভিন্ন অংশে বৃক্ষরোপন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্য সরকারের খাদ্যমন্ত্রী বাবু সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি ইতো মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এই জবই বিলকে ঘিরে বিল এলাকায় একটি অত্যাধুনিক ইকো পার্ক গঠনের ঘোষনা দেন, যাতে করে পর্যাটকরা বিলে এসে একটু স্বাচ্ছন্দবোধ করেন ও পাক-পাখালীদের সমন্বয়ে ভারা বিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

জবই বিল বীববৈচিত্র সংরক্ষন ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ জানান প্রতিবছর এ বিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক পর্যটক আসে। শীতে বিলের জীববৈচিত্রের প্রতি খেয়াল না করে তারা ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে সারা বিল ঘুরে বেড়ায়। এতে করে বিলে অবস্থানরত পাখির স্বাবাভিক বিচরণ বাধাগ্রস্থ্য হয়। তাছাড়া বিলে এখনও পাখি শিকারীদেরও অপচেষ্টা রয়েছে।

জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষন ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার এক জরিপ মতে গত ২০১৯ সালে এ বিলে পাতিসরালী ৩ হাজার, লাল ঝুঁটি ভুতি হাঁস ৫০টি, গিরিয়া হাঁস ২৫টি, পাতি-তিলি হাঁস ১২টি, টিকি হাঁস ৫০টি, পিয়াং হাঁস ৪শ’টি, কালা পাখ-ঠেঙ্গি ৫২টি, গেওয়ালা বাটান ৫০টি, চা-পখি ২শ’৮০টি, প্রশান্ত সোনা গিরিয়া ২শ’টি, পাতি ভুতি হাঁস ২শ’৫০টি, বেগুনী বক ৪টি, কানি বক ১শ’টি, বাজলা বক ১শ’২০টি, গো-বক ১শ’টি, শামুখ খোল ৪শ’টি পানকৌড়ী ৫শ’টি সহ মোট ৫হাজার ৫শ’ ৯৩টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ছিল।

সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান সহ এলাকার অভিজ্ঞজনদের মতে মৎস্য শিকারীদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করে ভবিষ্যতে বিলে দেশী ও পরিযায়ী পাখির আবাধ বিচরণ ধরে রাখতে পরিকল্পিত ভাবে বিলের কোন এক অংশে একটি জীববৈচিত্র সংরক্ষিত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে দেশের বৃত্তম ও অন্যতম জীববৈচিত্রে ভরপুর সহ পর্যটন সমৃদ্ধ বিল হিসেবে পরিচিত পাবে ঐতিহ্যবাহী জবই বিল।

এবিষয়ে সাপাহার উপজেলার নির্বাহী অফিসার কল্যাণ চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনিও একই মত প্রকাশ করে বলেন মৎস্য শিকারীদের কারণে একটু হলেও পাখিদের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তবে অচিরেই মৎস্য জিবীদের সাথে বৈঠক করে এবিষয়ে একটি সমাধান করা হবে। এছাড়া বিলটিকে পর্যাটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের খাদ্যমন্ত্রীও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারই সহযোগীতায় ইতোমধ্যে বিলে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। 

 

আরপি / এমবি-৭



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top