রাজশাহী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

গৃহহীন বিধবা জহুরার আক্ষেপ

‘কতজনেক ঘর দিল সরকার, জুটল না আমার কপালে’


প্রকাশিত:
২২ জানুয়ারী ২০২২ ২৩:৪৫

আপডেট:
২৩ জানুয়ারী ২০২২ ০৩:২৬

পঙ্গু ও বিকারগ্রস্ত ছেলে জিনারুলের পাশে জহুরা বেওয়া। ছবি: রাজশাহী পোস্ট

শেষ বয়সেও ভাগ্য বদলের প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার জহুরা বেওয়া। বয়স পেরিয়েছে ৬০। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে আহার জুটছে তার। সেই উপার্জন থেকেই প্রায় ২০ বছর ধরে তিন বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন দুর্ঘটনায় পঙ্গু এবং বিকারগ্রস্ত হওয়া ছেলে জিনারুলের মুখেও। তবে মনে খুব আক্ষেপ! নেই ভূমি নেই থাকার ভালো কোনো বাসস্থান। জহুরাকে ছেড়ে চলে গেছে ছেলেরাও সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের জন্য দেয়া ঘরও জুটেনি তার কপালে।

জহুরা বেওয়ার বাসা উপজেলার থানাপাড়া এলাকায়। তবে একই উপজেলার বড়বড়িয়া বেলতলী এলাকায় তার পিতার বাড়ি। স্বামী নইমুদ্দিন বিশ্বাসের মৃত্যুর পর চুলে আসেন মা-বাবার কাছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। একমাত্র ভাই চাকরি করছেন গ্রাম পুলিশের। আর বোনের বিয়ে দেয়া হয়েছে পার্শ্ববর্তী বাঘা উপজেলায়। জহুবার ৬ ছেলের ৫ জন জীবিত। একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত। বাকি চার ছেলের কেউ নেই তার পাশে। ফলে বেশ টানাপড়নে দিন কাটছে তার।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জহুরার ৬ ছেলের চারজনই ছিলেন পরিবহন ও নির্মাণ শ্রমিক। বড় ছেলে পশুর করাই। পঞ্চম ছেলে জিনারুলও ছিলেন একটি বাসের হেলপার। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ২০০১ সালে চারঘাটের আটঘরিয়া এলাকায় বাস- ট্রাকের সংঘর্ষ হয় মুখোমুখি। এতে মারা যান বাসটির ড্রাইভার। আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বাসের হেলপার জিনারুল। এরপর তার স্ত্রীও ছেড়ে চলে যায়। ফলে মা জহুরার কাঁধে এসে পড়ে জিনারুলের দায়িত্বভার।

এলাকাবাসী জানান, অনেকদিন আগে জজ মিয়া নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য এবং তার ভাই আব্দুল হাকিম সড়কের পাশে বাঁশ ও একটি টিনের চালা তুলে জিনারুলের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া কয়েকজন তার জন্য কম্বল ও পুরনো কাপড় দান করেন। তাতেই অতিবাহিত হচ্ছে জিনারুলের দিন-রাত। তবে তার মা বৃদ্ধা জহুরা বেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির লোকজন সরকারের বরাদ্দের ঘর করে দেয়ার কথা বলে কাগজপত্র নিলেও এখনো বাসস্থান পাননি তিনি।

জহুরা বেওয়া বলেন, ২০ বছর ধরে বিছানাগত জিনারুলের দেখাশোনা করে আসছি। বৃদ্ধাবস্থায় আমার সেবাযত্ন করার মানুষ তো নেই, উল্টো ছেলের দেখাশোনা করছি আমি। অন্য ছেলেরা ছেড়ে চলে গেছে।শীতকালে অন্যের জমিতে টিনের একটি খুপড়ি ঘরে কোনোমতে আছি। আর ছেলে জিনারুলকে রাস্তার পাশে টিনের চালা তুলে রেখেছি কোনোমতে।

তিনি বলেন, মাইষের (মানুষের) বাড়িত কাম-কাজ করে কিছু টাকা পাইছিনু (পেয়েছিলাম) আগে। এখন চোখেও দেখতে পাই না, কাজও করতে পারি না। নিজের থাকার জায়গাও নাই। জহুরা বলেন, কত মাইনষেক (মানুষকে) ঘর দিল সরকার। একখান ঘর চাইছিনু (চেয়েছিলাম)। মেম্বারের ছাওয়ালরা (ছেলেরা) কাগজও নিয়্যা গেছিল আমার, কিন্তু আমাক (আমাকে) কেউ ঘর দিল না।

আক্ষেপের স্বরে তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে জহুরুল মারা গেছে। আর জিনারুল পঙ্গু। আরো চার ছেলে কামরুল, জিয়ারুল, মিনারুল ও আমিরুল থাকলেও তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাদের পঙ্গু ভাই জিনারুলের পাশেও দাঁড়ায়নি কেউ। আমি মা আছি ছেলের পাশে, মৃত্যু পর্যন্ত থাকব।

এ বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে ছেলেকে নিয়ে এভাবে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন জহুরা। তার জন্য সরকারি ঘর এনে দিতে পূর্বের জনপ্রতিনিধিরা কাগজপত্র নিয়েছিলেন। আমি দায়িত্ব পেলে তার ঘর পাওয়ার বিষয়ে চেষ্টা করব।

এ ব্যাপারে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা সামিরা জানান, সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তার উপজেলায় ইতোমধ্যে ২৫ জনকে ঘর করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩০ জনের জন্য ঘর নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। আরো ৩৫ জনের গৃহ নির্মাণ করা হবে। ইউএনও বলেন, জহুরা বেওয়া কিংবা তার এলাকার জনপ্রতিনিধিরা যোগাযোগ করলে অবশ্যই তার ঘরের ব্যবস্থার জন্য চেষ্টা করব।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন বলেন, ভূমিহীনরা অবশ্যই ঘর পাবে। যাদের জমি আছে ঘর করার সামর্থ্য নেই, তাদেরও ঘর নির্মাণে সহযোগিতা করা হচ্ছে। জহুরা বেওয়া সেই ক্রাইটেরিয়াতে পড়লে এবং আবেদন করলে তাকেও ঘর করে দেয়া হবে।

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top