রাজশাহী শুক্রবার, ৮ই নভেম্বর ২০২৪, ২৫শে কার্তিক ১৪৩১

গ্রীন সিটিতে চোখ রাঙাচ্ছে শব্দ দূষণ, নিশ্চুপ প্রশাসন


প্রকাশিত:
১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৩২

আপডেট:
১৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:২২

ছবি: রাজশাহী পোস্ট

মহাকাল গড় থেকে রূপান্তরিত হয়ে রামপুর-বোয়ালিয়া ও পরে জায়গা করে নেয় রাজশাহী নামে। সেই রাজশাহী খ্যাতি পায় গ্রীন সিটি ও ক্লিন সিটি হিসেবে। কয়েক দশক আগের ধূলিকণা ও দুর্গন্ধময় শহরটি স্বীকৃতি পায় বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহরের। প্রকৃতির সবুজ প্রকৃতি ও পদ্মার নির্মল বাতাস উপভোগে জুড়ি নেই রাজশাহীর। তবে সেই রাজশাহীতেই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে শব্দ দূষণ।

রাজশাহীতে নগরায়ণের কয়েক বছরের ব্যবধানেই মাত্রাতিরিক্ত শব্দে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে বাসিন্দাদের। নগরীর ট্রাফিক এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, এমনকি নীরব এলাকাতেও এখন উদ্বেগজনক শব্দের মাত্রা। এতে শ্রবণ শক্তি হ্রাস, মেজাজ খিটখিটে, অনিয়মিত ঘুম, মাত্রাতিরিক্ত রক্ত চাপ, হার্টের ক্ষতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসসহ সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ শারীরিক সমস্যার।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের প্রথম এবং রাজশাহী বিশ্বের চতুর্থ শব্দ দূষণকারী শহর হিসেবে দেখানো হয়। যেখানে রাজশাহীতে শব্দের পরিমান দেখানো হয় ১০৩ ডেসিবেল। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাজশাহী শহরের পাঁচটি জনবহুল স্থানে দিনের বেলা নগরীর ব্যাস্ততম সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ২০২২ সালে, এবং একই স্থানে ২০২৩ সালে শব্দের মান নির্ণয় করে। পরিবেশ বান্ধব শহর রাজশাহীর পাঁচটি স্থান, তালাইমারী মোড়, রেইলগেট, বিসিক মঠ পুকুর, লক্ষিপুর মোড় ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় শব্দের মান নির্ণয় করা হয়।

বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে নগরীর রেলগেট ও লক্ষীপুর মোড়ে শব্দ দূষণের মাত্রা ছিল ৯০ ডেসিবেল, যা পুরো নগরীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৪ ডেসিবেল, বিসিক মোড় এলাকায় ৭৪ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৮৮ ডেসিবেল ছিল শব্দ দূষণের মাত্রা। তবে এক বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে শব্দ দূষণের মাত্রা নগরীর তালাইমারীতে ৮৬ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯০ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭২ ডেসিবেল, লক্ষীপুর মোড়ে ৮৯ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৮৭ ডেসিবেল পাওয়া যায়। দিনের চেয়ে রাতেও শব্দ দূষণের মাত্রা খুব একটা কম নয় বলেও পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে।

সবশেষ গত ১২ অক্টোবর সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৮ দশমিক ৮ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯৬ দশমিক ৩ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭৬ ডেসিবেল, লক্ষীপুর মোড়ে ৯৬ দশমিক ১ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৯০ দশমিক ৫ ডেসিবেল পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকৌশলী ড. জাকির হোসেন খান বলেন, অধিকাংশ যানবাহন অযথা হর্ন বাজাতে থাকে। বর্তমানে রাজশাহীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাটারিচালিত অটো এবং রিকশা বিদ্যমান। যেগুলো মূলত টিটি হর্ন ব্যবহার করে। নগরীর তালাইমারী ও রেলগেটে বাসগুলোকে অযথা হর্ন বাজাতে দেখা যায়। অটোরিকশায় ভেপু হর্ন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেন অন্য কোনো হর্ন ব্যবহার করতে না পারে। এছাড়া অটোরিকশা আর রিকশা নির্দিষ্ট লেনে দাঁড়ালে অহেতুক হর্ন দেওয়া অনেকাংশেই কমে যাবে।

শব্দ দূষণ প্রতিকারে তিনি বলেন, শহরের মধ্যে গতি সীমা নির্দিষ্ট করলে এর পরোক্ষ প্রভাব শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপর পড়বে। শব্দ দূষণের প্রভাব শুধু মানুষের উপর না, প্রতিটি পশু-পাখির উপর পড়ে। গাছ শব্দের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যথেষ্ট কার্যকর। আমের শহর রাজশাহীতে আম-জাম জাতীয় ফলের গাছ, নিম, সজনে জাতীয় উপকারী গাছ লাগানো যেতে পারে। যেগুলো বড় হলে শব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। সজনে গাছ বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন নির্গমনে কার্যকর গাছ গুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এসব গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা গেলে অনেকটাই কার্যকরী হতে পারে। মানুষের কথা চিন্তা করেই নীরব এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এসব সিরিয়াস রোগী, বয়স্ক ও শিশুরাও থাকে। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এসব এলাকায় শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ শব্দ দূষণের কারণে শ্রবন ক্ষমতা হ্রাস পায়, হার্ট এ্যটাকের ঝুঁকি বাড়ায়, ইরিটেশন ফিল করে, হাইপার টেনশন বেড়ে যায়, শিশুদের প্রতিবন্ধি করে তুলে ও অস্থিরতা বাড়ে।

এ ব্যাপারে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. এএসএম ইকবাল হোসাইন সাঈদ বলেন, উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণ কানের শ্রবণ ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় এই অবস্থায় থাকলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা থেকে বাঁচতে হলে রাস্তায় গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নগুলো কমাতে হবে। এটা নগর কর্তৃপক্ষকে সমাধান করতে হবে।

জানতে চাইলে রাসিকের প্রশাসক ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, শব্দের মাত্রা আসলেই বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে শহরে লাল-সবুজ অটোগুলো শৃঙ্খলা ভেঙ্গে একত্রে চলছে। পাশাপাশি মহানগরীর বাহিরের অটোরিকশাও শহরে ঢুকেছিল। মূলত যানবহন বেড়ে যাওয়ার কারণেই শব্দের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আবার চালকদের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে না। যার ফলে শান্ত ও সুন্দর নগরীতে শব্দ দূষণের পরিমাণ বেড়েছে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবৈধ গাড়ি মালিকদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছি। নীরব এলাকায় বরং শব্দ দূষণ আরও বেড়ে গেছে। আমরা অলরেডি অভিযান শুরু করেছি। অতিরিক্ত হর্ণ দিলে প্রাথমিকভাবে সতর্ক ও পরবর্তীতে শাস্তি নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, অন্যকে দোষারোপের অভ্যাসটা বাদ দিতে হবে। আমি একজনকে দোষারোপ করলাম, অন্যজন আরেকজনকে দোষারোপ করলাম এটা দুঃখজনক বিষয়। তারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করুক, সেটা কি আমাদের কাজ নাকি? ৫ তারিখের পর পরিবর্তিত পুলিশ আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। প্রায় ২০-২৫ দিন আগে থেকে দুই শিফটের অটো একত্রে চলা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র শুক্রবার দুই অটো এক সাথে চলে। যদি এই বিধান কেউ না মানে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

 

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top