রাজশাহী সোমবার, ১৪ই অক্টোবর ২০২৪, ৩০শে আশ্বিন ১৪৩১


গণতন্ত্রের বাহক যখন ভেড়ার মতো দড়িতে আটকা পড়ে ঘাস খায় তখন আর গণতন্ত্র থাকে না।

দেশের সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে কিনা, জনসাধারণকে জিম্মি করে রাখছে কিনা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করছে কিনা, ক্ষমতা কাঠামোর অপব্যবহার করছে কিনা- এ সবকিছুর পাহারদার হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম


প্রকাশিত:
১৭ মার্চ ২০২২ ০৭:০৮

আপডেট:
১৭ মার্চ ২০২২ ০৭:১৮

মেহেদী হাসান, সাংগঠনিক সস্পাদক, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ)

আমাদের মাথা মাছির মতো পুরোটাই চোখ না হওয়ায় শুধু সামনের দিকেই দেখতে পাই। পিছনে কি ঘটে তা দেখার আগ্রহ তখনই জাগে যখন- কেউ টেনে ধরে কিংবা শব্দের অনুভূতি হয়। মানুষের আগ্রহ জাগানো ও কোন বিষয়ে সচেতন করতে অগ্রগণ্য ভূমিকা গণমাধ্যমের।

স্বাভাবিকভাবে বলতে গেলে বৃহৎ গোষ্ঠির মধ্যে তথ্যের সরবরাহ করার জন্য যখন প্রযুক্তিগত মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয় তাই গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের সাথে যেহেত ু“গণ” শব্দটি জড়িয়ে রয়েছে; সেহেতু, জাতির বৃহৎ অংশের উপর গণমাধ্যম ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই প্রভাব ফেলছে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ অনুসারে এসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বহাল থাকায় এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে না। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেওয়ার কারণে সম্ভব হয়েছে। ঠিক তেমনি সামাজিক দরিদ্র-হতদরিদ্র শ্রেণী, জাতি, লৈঙ্গিক, যৌনতা বিষয়ক সমস্বার্থগত মিডিয়ার কভারেজ কিন্তু তেমন একটা দেখা যায় না।

চাকমা, মারমা, মুরং এসব জাতিকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন নিউজ চোখে পড়বে না। আবার লৈঙ্গিক বিষয়ে- একজন ধর্ষণকারীর ছবি মিডিয়ার নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পায় কিন্তু ভিকটিমের নয়। অথচ উভয়ের সামাজিক মূল্যমান রয়েছে। আবার পুলিশ একজন সন্দেহপ্রবণ আসামিকে ধরে মিডিয়ায় প্রকাশ করে-আসামি হিসেবে। কিন্তু তখনও প্রমাণিত হয়নি সে আদৌ দোষী কিনা?

ফুটপাতের টোকাইদের নিয়ে কোন নিউজ চোখে পড়ে না কারণ এর পেছনে বৃহৎ গোষ্টির হাত রয়েছে। ফুটপাতের টোকাইদেরও নূন্যতম অধিকার রয়েছে বেঁচে থাকার। আর যখন সে দেখে এই রাষ্ট্র শুধুমাত্র তাদের শোষণ করছে আর ব্যবহার করছে তখন সে আত্মঘাতী হয়ে উঠে। স্থানীয় নেতা কিংবা ব্যবসায়ীর গোপন চোখ ও হাত হিসেবে বেড়ে উঠে ফুটপাতের টোকাই। কারণ হাজার টাকার পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁকে দিয়ে ইচ্ছেমতো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ঐ কর্তাব্যক্তিরা এ কারণেই হয়ত তাদের পুন:বাসন করেন না; রাষ্ট্র তাতে সাঁয় দেয় না। রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না এ কারণেই যে-রাষ্ট্র খোদ নিজেই টিকে আছে একটা কথা সর্বস্ব বুলি আওড়ানোর উপর।

সামাজিক সমস্যা যেমন- ধর্ষণ, সহিংসতা, উৎপীড়ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। একদিকে মিডিয়া নারী পুরুষের অবৈধ সম্পর্ককে জায়েজ বানিয়ে প্রচার করছে বিভিন্ন উপায়ে। অন্যদিকে “তিন বছর ধরে ধর্ষণ” শিরোনামে প্রচার করছে। সুবিধাভোগী নারীবাদীরা আবার কখনো রাস্তায় নামছে প্রতিবাদ জানাতে। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম নারীর ক্ষমতায়ন নাকি অসহায়ত্ব প্রচার করছে তা নিয়ে কোন গবেষণা নেই। একই জায়গায় কখনো শয়তার আর ফেরেশতা বসতে পারে না। যদি ধর্ষণ হয়ে থাকে তাহলে সেখানে প্রেম-প্রণয় ছিলনা। আর এসব দ্বৈতনীতির ফলাও প্রচারকারী পশ্চিমা মিডিয়া। তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার আমরা। প্রভাবও লক্ষ করা যাচ্ছে ইতোমধ্যে। তবে, সরকার এ বিষয়ে তেমন সোচ্চার হয় না চেয়ারের পায়া রক্ষার খাতিরে।

গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় ভূমিকা বহুল গণতান্ত্রিক আয়োজনে সামিল হওয়া। কেননা গণমাধ্যম গণতন্ত্রের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে। গণতন্ত্রে পথকে মসৃণ করে। গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে গণতন্ত্রমণা গণসচেতনতা সৃষ্টি। দেশের সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে কিনা, জনসাধারণকে জিম্মি করে রাখছে কিনা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করছে কিনা, ক্ষমতা কাঠামোর অপব্যবহার করছে কিনা, প্রার্থীতা নির্বাচনে সঠিক মতামত প্রদান ও অংশগ্রহণ করতে পারছে কিনা- এ সবকিছুর পাহারদার হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম। এখন প্রশ্ন একটা থেকেই যায়- পাহারাদারকে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে রাখলে কি আর পাহারা দিতে পারে? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া গণতান্ত্রিক ভরণপোষণ সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে গণযুদ্ধের “বিজয় মুকুট” হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

প্রাযুক্তিক সম্পর্কজালে যে আমরা জড়িয়ে পড়েছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গণমাধ্যমের নৈতিকতা ,সহিংসতামূলক আচারণ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাব রাখছে। গণমাধ্যমের শ্রেণীসংগ্রাম, বর্ণ, লিঙ্গ এবং বৈষম্যমূলক আচারণ সহযেই লক্ষ করা যাবে যদি “চোখ সাফ রাখা যায়”। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো গণতান্ত্রিক মিডিয়ার মোড়কে কর্পোরেট মিডিয়া। কর্পোরেট মিডিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য হলো-জনগণকে খুব একটা পাত্তা না দেওয়া। আর এ পাত্তা না দেওয়ায় কর্পোরেটীয় সংরক্ষণবাদী ও আধিপত্যবিস্তারকারীর মতাদর্শগুলোকে বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেওয়া।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৪ সালে ফেডারেল কমিউনিকেশন ধারার মাধ্যমে সে দেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। জনস্বার্থ, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও অন্যান্য জনস্বার্র্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৮০-৯০ এর দশকে তা উল্টো হয়ে যায়। অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সরকারি বেসরকারি আমলা ও ব্যবসায়িক একীভূতকরণের মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে। আর তখন থেকেই গণমাধ্যমের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব হারিয়ে যায়। দখল হয়ে যায় কর্পোরেটীয় আধিপত্যে।

বর্তমানে রাজনৈতিক ও কর্পোরেটীয় আধিপত্যের কারণে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যা সারা জাতিকে ভুগতে হচ্ছে। নাগরিক মতাদর্শিক বিতর্কিত ইস্যু, গণতান্ত্রিক সংলাপ, ব্যঙ্গাত্মক উন্মুক্ত আড্ডা কোন কিছুই সম্ভব হচ্ছে না শুধুমাত্র গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতার ফলে। আর এটা হয়েছে গণমাধ্যমের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে। গণমাধ্যম সবশেষে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বাধ্য হয়; হয়ে যায় পক্ষপাতিত্বপূর্ণ কাঠামোগত চরিত্র।

গণতন্ত্রের বাহক যখন ভেড়ার মতো দড়িতে আটকা পড়ে ঘাস খায় তখন আর গণতন্ত্র থাকে না। ঘাস হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় আর মেদ জমায়। এই ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের শোষণ থেকে বাঁচতে হাটে বাজারে গড়ে উঠছে- কলোনী আকারের ছোট ছোট সংগঠন। “কাচাবাজার সমিতি, মুরগি পালন সমিতি, চেতনা সমিতি”! বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই।

 

মেহেদী হাসান
শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী কলেজ
সাংগঠনিক সস্পাদক, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ)

নিজস্ব প্রতিবেদক এগ্রিকেয়ার২৪.কম এবং জেলা প্রতিনিধি শেয়ার বিজ

 

 

আরপি/এমএএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top