রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


১৯ মে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন


প্রকাশিত:
২০ মে ২০২০ ০২:৫৪

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:২৯

বামে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ ও ডানে শহীদদের ছবি

ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সচরাচর আমাদের বায়ান্ন এর ভাষা আন্দোলন কে বুঝি এবং জানি, কিন্তু ভারতের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন (১৯৬০-৬১) এর কথা আমরা অনেকে জানিনা। বরাক উপত্যকা আসামের বরাক নদীর নামে নামকরণকৃত, ৪৭ এর দেশভাগের আগে বৃহত্তর কাঁছাড় জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা গঠিত, বর্তমানে কাঁছাড় বিভক্ত হয়ে ৩ টি প্রশাসনিক জেলা হয়েছে যথাক্রমে কাঁছাড়,করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা।

তৎকালীন বরাক উপত্যকায় প্রায় ৪০ লক্ষ নাগরিকের বসবাস ছিল। যার শতকরা ৮০ ভাগ বাঙালি। এছাড়াও পুরো আসামজুড়ে বাঙালিদের ব্যাপক বসবাস ছিল। বিশ শতকের পূর্বে ব্রিটিশরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির মাধ্যমে আসামিয়াদের বাঙালিদের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে থাকে এবং অসমিয়ারাও ভাবা শুরু করে বাঙালিরা তাদের কাজের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। বাঙালির সংস্কৃতির দ্বারা অসমীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছে।

ফলে ১৯৪৭ এর পরে থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা মানসিক ভয়ে ভীত হয়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। বিভিন্ন আইন ও প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে Assam Official Language Act (ALA 1960) নামে একটি আইন পাশ হয়। এই আইনের ঘোষণার সাথে সাথে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতন অসন্তোষ বাঙালি অধ্যুষিত কাঁছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাংলাভাষীরা সম্মিলিত আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হওয়া শুরু করলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং জুলাই সেপ্টেম্বর মাসের অসমিয়ারা কামরুপ জেলায় বাঙালিদের ওপর বাঙাল খেদাও নামে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ব্যাপক হত্যাকান্ড ও ধ্বংসের স্বীকার হয়ে ৫০ হাজার বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে এবং ৯০ হাজার বাঙালি বরাক উপত্যকার ও আসামের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে।

৬১ সালের প্রথমে আবার ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলে বিভিন্ন গণসংগঠন তৈরি হয়। নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি, ভাষা, সংগ্রাম পরিষদ অগ্রগণ্য। এ সকল সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদের গৃহিত Assam official language act 1960 বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। এমনকি জেলা কংগ্রেস কমিটি গঠিত ভাষা আন্দোলন সমিতিও এ প্রতিবাদে শামিল হয়। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র জনতা, যুবসমাজ সুধীসমাজ ও বুদ্ধিজীবি সমাজ আন্দোলনে যোগ দিলে আন্দোলন প্রথমে শান্তিপূর্ণ থাকলেও চলমান আন্দোলনকে বেগবান ও সাধারণ মানুষের মাঝে বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে কাঁছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচীর সূচনা হলে এই পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ ও কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ রা মে আবার শিলচরে শেষ হয়। পদযাত্রার পর সমগ্র বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে গণসংগ্রাম পরিষদ এর সভাপতি রথীন্দ্র নাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মের মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান না করা হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল সন্ধ্যা হরতাল আহবান করা হবে।

কিন্তু আসাম সরকার তাদের এই দাবি কে কর্ণপাত না করে ১৮ মে গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন সহ ভাষা আন্দোলনে জড়িত নলিকান্ত দাস বিধুভুষণ চৌধুরীর মতন নামকরা ব্যক্তিত্বদের আটক করে। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা, সকাল থেকে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার রেল স্টেশন , অফিস আদালত ও সরকারি ভবনে অবস্থান গ্রহণ করে।

অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে গণজোয়ার দেখে আসাম সরকার ভীত হয়ে জেলা শহরগুলিতে আধা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। দুপুরের পর আসাম রাইফেলস ও পুলিশ অবস্থান ধর্মঘটকারীদের ওপর চড়াও হয়ে হামলা চালায়। বেলা আড়াইটার দিকে ধর্মঘট পালনকারী ৯ জন বাঙালিকে কাটিগড়া থেকে আটক করে শিলচরের পাশে দিয়ে তারাপুর স্টেশনের দিকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় স্টেশনে অবস্থানকারী উত্তেজিত জনতা ট্রাকটি ঘিরে ফেললে পুলিশরা ভয়ে পালিয়ে যায় এবং জনতা ট্রাকটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ট্রাকে আগুন লাগা দেখে কাটিগড়া থানার অফিসার রেবতি পাল ফায়ার ফায়ার বলে চিৎকার শুরু করলে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমলা ভট্টাচার্য-সহ ১১ জন বাঙালির প্রাণ একেরপর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ১১ জনের মধ্যে ৯ জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দুজন-সহ মোট ১১ জন তরুণ তাজা প্রাণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় সমগ্র ভারতে আন্দোলনের দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠলে দিল্লি জাতীয় কংগ্রেস লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে চলমান সংকটের উপায় উদ্ভাবনের দ্বায়িত্ব দেন।

লালবাহাদুর শাস্ত্রী ALA - 1960 সংশোধনের বেশ কিছু প্রস্তাবনা (বিস্তারিত) পেশ করেন এবং ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে আসাম প্রাদেশিক সরকার লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী ALA - 1960 সংশোধন করে "বাংলা"কে কাঁছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

আজ ১৯ মে ১৯৬১ সালের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। 

লেখক:

ওয়ালিদ আহমেদ কমল

সাবেক সহ-সম্পাদক

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top