নিরাপদ ঈদযাত্রা: স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন?

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই উৎসব আর প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো কিছু দুর্দান্ত মুহূর্ত। কিন্তু এই আনন্দের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে ঈদযাত্রা। যা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো হলেও বাস্তবে তা হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্নের মতো। বাংলাদেশে প্রতি বছর ঈদের সময় লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের পথে রওনা দেয়। কর্ম জীবনের ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে প্রিয়জনদের সাথে ঈদ কাটানোর আশায় ঘর ছাড়ে অনেক মানুষ। কিন্তু এই যাত্রা মোটেও সহজ নয়। যাত্রাপথে লঞ্চ ডুবি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ আরো যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতির কারণে ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে হয় না। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট, টিকিট সংকট, পরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া তো আছেই। কিন্তু এসব সমস্যা আমরা কি এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি?
না, পারি নি। প্রতি বছর ঈদ আসলেই লাখো মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সড়ক, রেল ও নৌপথ। ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনাল গুলোতে নেমে আসে মানুষের ঢল। টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন, অতিরিক্ত ভাড়া, যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা—সবকিছু মিলিয়ে ঈদযাত্রা হয়ে ওঠে অনেক কষ্টদায়ক। এছাড়াও মহাসড়কে যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুসারে ২০২৪ সালের ঈদ যাত্রায় ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন যাত্রী নিহত ও ১৩৯৮ জন যাত্রী আহত হয়েছে। ঠিক একই সময়ে রেলপথের ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছে। এমনকি নৌপথে ২টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথের সব মিলিয়ে ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১৪২৪ জন যাত্রী আহত হয়েছে। এসব পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেয় যে ঈদযাত্রার নিরাপত্তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
ঈদযাত্রা আমাদের দেশে এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যানজট কমানো, পরিবহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা এসব নিয়ে প্রতি বছর অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর পরিবর্তন খুব কমই চোখে পড়ে। এজন্য আমাদের প্রত্যেকেরই নিরাপদ ঈদযাত্রার বিষয়ে সচেতন হাওয়া এবং সতর্কতা অবলম্বন করা অনেক জরুরী।
বাংলাদেশের প্রধান যাতায়াত মাধ্যম হলো সড়কপথ। কিন্তু ঈদযাত্রার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সড়কপথের নিরাপত্তাহীনতা। অপ্রতুল যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের ক্লান্তি হলো সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। তাই যাত্রীদের অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিয়ে লাইসেন্সকৃত ও নিরাপদ বাহনে ভ্রমণ করতে হবে। প্রতিবছর ট্রেন ও লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনের ছাদে ওঠা, লঞ্চে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নেওয়া, অযথা তাড়াহুড়ো করা ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
অন্যদিকে ঈদযাত্রার আরো একটি অন্যতম সমস্যা হলো টিকেট সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়া। ঈদের সময় বাস, ট্রেন, লঞ্চ সবধরনের পরিবহনের ক্ষেত্রেই টিকিট পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যায়। এমনকি অনলাইনে টিকিট থাকলেও তা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। যার ফলে কালোবাজারিরা এর সুযোগ নিয়ে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করে। যার কারণে যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। তাই কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এমনকি যাত্রীদেরও উচিত নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া না দেওয়া এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
অনেক সময় বাস, ট্রেন ও লঞ্চে দেখা যায় যাত্রীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে খাবার, পানি বা চকলেটের সাথে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয় এবং একবার অজ্ঞান হয়ে গেলেই সহজেই তাদের থেকে টাকা, মোবাইল, লাগেজ, এমনকি টিকিট পর্যন্ত নিয়ে নেওয়া হয়। এমনকি যাত্রাপথে বিশেষ করে রাতে, ছিনতাইকারীরা যাত্রীদের চোখে ঝাঁঝালো রাসায়নিক বা মলম ছিটিয়ে দেয়। যার ফলে চোখে অনেক জ্বালা করে। ফলে সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। যার কারণে এই সুযোগে ছিনতাইকারীরা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। বাস, ট্রেন বা লঞ্চের ভিড়ের সুযোগ নিয়ে চোররা ব্যাগ কেটে বা হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নেয়। বিশেষ করে ব্যস্ত স্টেশন বা ফেরিঘাটে যাত্রীদের অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে।
ঈদযাত্রার সময় যাত্রীদের জন্য আরো একটি নিরাপত্তাহীনতার বড় দিক হলো নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা। বিশেষ করে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা। দেখা যায় যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন ও লঞ্চে নারীরা প্রায়ই বিভিন্ন ধরণের হয়রানির শিকার হয়। যেমন বাস বা ট্রেনের ভিড়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে গায়ে হাত দেওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, অশালীন মন্তব্য ইত্যাদি আরো অনেক ঘটনা ঘটে থাকে।
এসকল প্রতারণা থেকে বাঁচতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে। এজন্যে অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার বা পানি গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি টিকিট ও টাকা-পয়সা নিজ নিরাপত্তায় রাখতে হবে এবং ব্যাগে মূল্যবান জিনিস সহজে খোলা যায় এমন জায়গায় রাখা যাবে না। বিশেষ করে রাতের যাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে। এমনকি ভিড়ের মধ্যে সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলে পাশের যাত্রীদেরও সতর্ক করতে হবে। অনলাইনে টিকিট কাটার সময় বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে হবে। এমনকি সিট বুকিং এর সময় নারী ও পরিবারবান্ধব পরিবহন বেছে নিতে হবে।
ঈদযাত্রার আনন্দ যেন কোনোভাবেই ভয় বা আতঙ্কে পরিণত না হয় সে জন্য যাত্রীদের সতর্ক থাকা অনেক জরুরি। ঈদযাত্রা আমাদের আনন্দের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা এবং অনিয়মের কারণে ঈদ যাত্রা অনেক সময় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। তবে সঠিক পদক্ষেপ এবং সচেতনতার মাধ্যমে আমরা ঈদযাত্রাকে নিরাপদ ও আনন্দময় করতে পারি। এজন্য দুর্ঘটনা নয় বরং নিরাপদ যাত্রায় হোক ঈদযাত্রার অঙ্গীকার।
সৈয়দা ফারিভা আখতার
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।
আরপি/আআ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: