রাজশাহী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


বোরখা পরে

সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার এবং দুর্ঘটনারোধে বোরখা, ভিক্ষুক এবং হারিকেন অভিযান


প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০১৯ ০৯:৩৬

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:২৬

ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৯ সালের ২রা জানুয়ারী রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানা থেকে বদলী সূত্রে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুর থানার ও.সি হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো যোগদান করি। এর আগে ১৯৯৪ সালেও আমি ও.সি হিসেবে এই থানায় চাকুরী করেছি। তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ উত্তর জনপদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও প্রশাসনিক থানা শাহজাদপুর। শাহজাদপুর থানা শুধু সিরাজগঞ্জ জেলায় নয়, উত্তর বঙ্গের একটি ব্যস্ততম থানা। ভৌগলিক অবস্থান, ব্যবসা কেন্দ্র, কলকারখানা ও বিশাল হাইওয়ের দিক থেকে এ থানার গুরুত্ব অপরিসীম। শাহজাদপুরকে বাণিজ্যিক শহরও বলা হয়। এখানে রবীন্দ্র কাচারী বাড়ী, নদী বন্দর, মিল্কভিটার মূল অফিস ও কারখানা এবং টেক্সটাইল মিল রয়েছে। সম্প্রতি এখানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারীভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এই থানার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। এখানকার তাঁতে তৈরী শাড়ী, লুঙ্গি এবং দুধ, ঘি, ঘিয়ে ভাজা পানতোয়া খুবই বিখ্যাত। এখানে শিক্ষিতের হার বেশী এবং থানাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী হলেও অপরাধ প্রবণ এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।

শাহজাদপুর থানায় যোগদানের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, মামলা তদন্ত ইত্যাদি সবক্ষেত্রে সফলতা এলেও থানায় মুলতবী বিপুল সংখ্যক গ্রেফতারী পরোয়ানা তামিলের ক্ষেত্রে খুব একটা সফলতা আসছিলো না। এজন্য মাসিক অপরাধ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মহোদয়ের কাছে থেকে অম্লমধুর বাক্যবানে সবসময় জর্জরিত হতে হয়। গোপন সূত্রে জানা যায়, আসামীদের অনেকেই দিনের বেলা এবং সন্ধ্যের সময় শাহজাদপুর বাজারে নিশ্চিন্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাদের একেকজনের নামে ৭/৮ টি করে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা তাদের চিনি না। তারা খুবই ধুরন্ধর, পুলিশ দেখলেই সরে পড়ে। তাছাড়া তারা এতই দুর্ধর্ষ্য এবং ভয়ংকর যে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ধরিয়ে দিতে কিংবা তাদের সন্ধান জানতে ভয় পায়। রাতে বাড়ীতে একাধিকার অভিযান করেও তাদের কখনই পাওয়া যায় না। কারণ গ্রেফতারের ভয়ে রাতে তারা বাসায় থাকতো না। এ নিয়ে চারিদিকে পুলিশের কড়া সমালোচনা হতে থাকে। খবরের কাগজে অহরহ পুলিশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক খবর ছাপা হয়। আমিও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিতর্কিত এবং সমালোচিত হতে থাকি। উর্দ্ধতন অফিসারের নিকট কৈফিয়ৎ দিতে দিতে আমি ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি আমার জন্য বিব্রত এবং অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বৃটিশী পন্থায় আসামী গ্রেফতারের পদ্ধতি অবলম্বন করে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে না পারায় আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করি। প্রথমে শুরু হয় বোরখা পরে আসামী ধরার অভিযান। পুলিশ বিভাগে আমিই প্রথম এবং একমাত্র ও.সি হিসেবে আসামী ধরার জন্য বোরখা পরে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করি। আমার চাকুরী জীবনে এটি বোরখা অভিযান হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত, প্রশংসিত, প্রচারিত, আলোচিত এবং স্মরণীয়।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি একদিন রাত্রিতে একাই শাহাজাদপুর বাজারের একটি দোকান থেকে আমার মিসেস পরবেন বলে ১০টি বোরখা কিনে এনে পরিদর্শন রুমে গোপনে রেখে দেই। পছন্দমতো দু’টি রেখে বাকি আটটি ফেরত দেওয়া হবে বলে দোকানদারকে জানানো হয়। পরের দিন বিকালে ১ জন সোর্স এবং ৮ জন হালকা পাতলা অল্পবয়সী কনষ্টেবলকে বোরখা পরিয়ে আমি নিজেও বোরখা পরিধান করি। কনস্টেবলরা প্রথমে বোরকা পরতে রাজী হচ্ছিল না কিন্তু আমি তাদেরকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই। কেউ যেন সন্দেহ না করে সেজন্য আগে থেকে এনে রাখা লেডিস জুতা, স্যান্ডেল এবং সাদা কেড্স প্রত্যেককে পরানো হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক আগে থেকে দু’টি রিকসা-ভ্যান এনে ব্যারাকের পিছনে রাখা হয়। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ঐদিন থানার অন্যান্য অফিসার ও কনষ্টেবলদেরকে টহলে পাঠানো হয়। সন্ধ্যের সময় থানার ব্যারাকের পিছনের বাতি নিভিয়ে আমরা একে একে দশজন বোরখা পরিহিত অবস্থায় ব্যারাকের দোতলা থেকে নেমে ৫ জন করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে দু’টি রিকশা ভ্যানে আরোহন করি। ব্যারাক থেকে এক সঙ্গে বোরখা পরে ১০ জন মহিলাকে বের হতে দেখে ভ্যানচালকরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এদিকে কপাল খারাপ হলে যা হয়। ঐ সময় আমার এবং এস.আই সাইফুলের স্ত্রী সান্ধ্যকালীন হাটার সময় ব্যারাকের পিছনে বাতি নিভানো অবস্থায় ১০ জন মহিলাকে বোরখা পরে ব্যারাক থেকে বের হতে দেখে হতভম্ব হয়ে যান। কিন্তু কিছু না বলে আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়ে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে যান।
গোপন সূত্রে পূর্বেই আমরা জেনেছিলাম যে, আসামীরা সন্ধ্যের পরে প্রতিদিন শাহাজাদপুর বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। তাদের ধরার জন্য আমরা শিকারী বিড়ালের মতো সন্তর্পনে শাহাজাদপুর বাজারে এগিয়ে যেতে থাকি। রাস্তায় কেউ আমাদেরকে কোন রকম সন্দেহ করে না। তাছাড়া সন্দেহ করার কোন অবকাশ ছিল না। কারণ বোরখা অভিযান করার জন্য আমরা আটসাট বেঁধে নেমেছিলাম। এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। থানার কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই বোরখা অভিযান সম্পর্কে জানতো না। ভয় ছিলো যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে সব পরিশ্রমই বৃথা হয়ে যাবে। বোরখা অভিযানের জন্য প্রত্যেকে ভিতরে খাকি ইউনিফরম পরে পায়ে লেডিস স্যান্ডেল, জুতা এবং উপরে কালো বোরখা পরে নেই। নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেকে ছোট অস্ত্র বহন করেছিলাম। আমার ভ্যানে সোর্স ছিলো। সে আসামীদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আমার পাশে বসে। গরমে আমরা সেদ্ধ হতে থাকি। কারণ এর আগে তো কোন দিন বোরখা পরিনি। এটা এক দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
অনুমান ১০ মিনিট পর আমরা শাহজাদপুর বাজারে পৌঁছার সাথে সাথে সোর্স কানের কাছে মুখ নিয়ে জানায়, ৮/১০ জন টপ টেরর চায়ের দোকানে বসে আছে। দূর থেকে সোর্স ইশারায় তাদের চিনিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীদের সনাক্ত করে সবাই এলার্ট হয়ে রেডী পজিশনে চায়ের দোকানের সামনে যেয়ে বোরখা পরিহিত অবস্থায় তড়িৎ গতিতে ভ্যান থেকে লাফিয়ে নেমে ৬ জন আসামীকে জাপটে ধরি। বাকীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বোরখা পরা মহিলা কর্তৃক আসামীদের জড়িয়ে ধরতে দেখে এলাকায় লোক হতবিহ্বল এবং কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে। তাদের মাঝে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আমি এবং কনষ্টেবলরা বোরখার মুখের অংশ সরিয়ে ফেলি। আমাদের দেখে উপস্থিত জনগণ বুঝতে পারে আসামী ধরার জন্য কৌশল হিসেবে আমরা বোরখা পরেছি। আমাদের দেখার জন্য লোকজন চারিদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। উৎসাহী জনতা উৎফুল্ল হয়ে জানায়, জীবনে কোন ও.সি এবং পুলিশকে বোরখা পরে আসামী ধরতে দেখে নাই। এই অভিনব পন্থায় আসামী ধরার জন্য তারা আমাদেরকে বিপুলভাবে প্রশংসিত করে বোরখা অভিযান অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করেন। ঘটনা দেখার জন্য চায়ের দোকানের সামনে লোকে লোকারন্য হয়ে যায়।
এদিকে পুলিশ কর্তৃক বোরখা পরে শাহজাদপুর বাজার থেকে গ্রেফতারের সংবাদ মুহুর্তের মধ্যে বাজার এবং থানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি দারুনভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে হৈ চৈ পড়ে যায়। সংবাদ পেয়ে থানা থেকে ১ জন অফিসারের নেতৃত্বে ০৭ জন ফোর্স পিক আপ ভ্যানে চায়ের দোকানের সামনে এসে আমার নিকট রিপোর্ট করে গ্রেফতারকৃত ৬ জন সন্ত্রাসীকে থানায় নিয়ে যায়। থানার রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, প্রত্যেকের নামে বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত ৬/৭ টি করে ওয়ারেন্ট আছে। ঐ দিন সর্বমোট ৪৪টি ওয়ারেন্ট খারিজ হয়। বোরখা অভিযানের ফলে একদিনে এত সংখ্যক ওয়ারেন্ট খারিজের এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

বোরখা অভিযান শেষে রাত্রিতে বাসায় এলে স্ত্রী আমার উপর প্রচণ্ড রাগারাগি করে থানা পুলিশের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি ঘৃণা প্রকাশ করে থানায় বোরখাপরা মহিলাদের আগমনের বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি ঘটনা তা নয়, ততই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং প্রকৃত ঘটনা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে অযথা রাগারাগি করতেই থাকেন। পরের দিন সকালে বাবার বাড়ী চলে যাবার কথা জানিয়ে ঐ রাত্রিতে তিনি অভিমান করে আমার সাথে কথা না বলে না খেয়েই রাত্রি পার করেন। আমিও না খেয়ে থাকি।
পরের দিন প্রথম আলো, ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ, সংবাদ, বাংলা বাজার, করতোয়া ইত্যাদি অনেক জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় বোরখা পরে আসামী গ্রেফতারের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। এর মধ্যে পত্রিকার সংবাদ পড়ে পুলিশ সুপার এবং সার্কেল এ.এস.পি মহোদয় বিস্তারিত ঘটনা জেনে আমাকে ধন্যবাদ জানান। একসঙ্গে এতো গ্রেফতারী পরোয়ানা খারিজ হওয়ার জন্য তারা বোরখা অভিযান অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করেন। বোরখা অভিযানের খবর পড়ে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। অনেকেই বোরখা অভিযান সম্পর্কে জানার জন্য ফোন করতে থাকে। সকালে প্রথম আলো পত্রিকায় বোরখা অভিযানের খবর পড়ে আমার স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গে এবং রাত্রির আচরণের জন্য খুবই লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হন। পরিবেশ হালকা করার জন্য তিনি রসিকতা করে বলেন, এখন থেকে বাসায় দু’টি বোরখা থাকবে। একটি তার এবং অন্যটি আমার জন্য। একথা শুনে হেসে ফেলি। এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বোরখা অভিযানের সংবাদ ফলাও করে ছাপা হতে থাকে। নিম্নে কয়েকটি পত্রিকার সংবাদ উদ্ধৃত করা হলো।

প্রথম আলো
২৪ ফেব্রুয়ারী ২০০০
বোরকার ফল

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানা পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও দাগি আসামীদের ধরতে পারছিল না। থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার সম্প্রতি বাজার থেকে কিনে আনেন ১০টি বোরকা। এই বোরকা পরে গত মঙ্গলবার আসামী ধরার অভিযানে বের হয় পুলিশ। প্রথম দিনেই আসে অভূতপূর্ব সাফল্য। ধরা পড়ে ছয়জন আসামী। পুলিশের এই অভিনব কৌশল সাধারণ জনগণ স্বস্তিবোধ করলেও অপরাধীরা আতংকিত হয়ে পড়েছে। শাহজাদপুর প্রতিনিধি।

দৈনিক ইত্তেফাক
২৬ শে ফেব্রুয়ারী ২০০০
বোরখা আতংক

পাবনা সংবাদদাতা: শাহজাদপুরে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজসহ সকল প্রকার অপরাধীদের মধ্যে এখন ‘বোরখা’ আতংক শুরু হইয়াছে। শাহজাদপুর থানার পুলিশ দাগী অপরাধীদের ধরিতে বারংবার ব্যর্থতার পরিচয় দিলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কনষ্টেবলদের জন্য ১০টি বোরখা কিনিয়া আনেন। পুলিশরা এই বোরখা পরিয়া অভিযান চালাইলে প্রথম দিনেই ধরা পড়ে ৬ জন কুখ্যাত অপরাধী। এখন বোরখা দেখিলেই অপরাধীদের হৃদকম্পন শুরু হইতেছে।
সংবাদ

২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০০
বোরকা অভিযান

শাহজাদপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা: গত সোমবার রাতে শাহজাদপুর থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে থানা পুলিশ ‘বোরকা অভিযান’ চালিয়ে একাধিক মামলার ৬ জন দাগী সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। বোরখা অভিযান অব্যাহত থাকায় টপ টেরররা এখন বোরকা পরা মহিলাকে দেখেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

বাংলা বাজার পত্রিকা
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০১

বোরকা আতংক
শাহজাদপুর থানায় এখন চলছে রীতিমতো বোরকার আতংক। না কোন মৌলবাদ উগ্রপন্থীদের অপ তৎপরতা নয়। রীতিমতো আমেরিকান নিনজাদের মতো সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম দাপটের সাথে বোরকা পরে পাকড়াও করছেন সন্ত্রাসীদের। এ পর্যন্ত গত এক বছরে তিনি প্রায় সাড়ে তিনশত অপরাধীকে গ্রেফতার করেছেন।
বোরখা সাধারণত মহিলারাই পরে থাকেন। কিন্তু বোরখা পরে আসামী ধরতে কত যে সুবিধা সেটা আমি ছাড়া আর কেউ হয়তো অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন না। কারণ বাস্তবে আসামী ধরার ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে বোরখা পরে আমি ব্যাপকভাবে সফল হয়েছি। আর দিনের বেলায় বোরখা পরে আসামী ধরা সহজ এবং এ পন্থায় ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। শাহাজাদপুর থানার অপরাধ দমনে বোরখা অভিযানের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরার ক্ষেত্রে। একটি থানায় যদি গ্রেফতারী পরোয়ানার এবং এজাহার নামীয় আসামীদের নিয়মিতভাবে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয় তবে এলাকায় অপরাধ বহুলাংশে কমে যাবে। অপরদিকে আদালতেও বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়ে মানুষ ন্যায় বিচার লাভে সমর্থ হবেন।

বোরখা অভিযানের ব্যাপারে আসামীরা সতর্ক হলে তাদের গ্রেফতারের জন্য নেওয়া হয় আরেকটি অভিনব পন্থা। সেটি হলো ভিক্ষুক সেজে আসামী গ্রেফতার। তখন থানা এলাকায় কয়েকটি জায়গায় রাত্রিতে যাত্রা অনুষ্ঠান হতো। যাত্রার মেকআপম্যানকে গোপনে থানায় আনা হতো। তিনি মেকআপ করে আমাদেরকে ভিক্ষুক সাজাতেন। ভিক্ষুক বেশে সুবিধা এই যে, ভিক্ষার অছিলায় সহজেই আসামীর বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করা যায়। আর বাড়ীতে প্রবেশ করে আসামী দেখার সাথে সাথেই দেরী না করে তাকে গ্রেফতার করে আইডি কার্ড শো করতাম। এখানে মজার ব্যাপার হলো, যারা সত্যিকার ভিক্ষুক তারা কোন অপরাধীর বাসায় ভিক্ষা করতে গেলেই তাদের দেখে আসামী পালিয়ে যেত। ফলে তারা আশ্চর্য এবং বিব্রত হতো কিন্তু ভিক্ষা পেতো না। অনেক ভিক্ষুক থানায় এসে অভিযোগের মাধ্যমে জানায়, আমরা ভিক্ষুক সাজার কারণে তারা ভিক্ষা পাচ্ছে না। সত্যিকারের ভিক্ষুক হওয়া সত্ত্বেও মানুষ তাদের পুলিশের লোক ভাবছে। ফলে তারা ভিক্ষা না পেয়ে পরিবারসহ না খেয়ে থাকছে। ভিক্ষুকরা দুঃখে থাকলেও আমরা কিন্তু সফলতার আনন্দে ভাসতে থাকি। ভিক্ষুক অভিযান পরিচালনা করে ইতোমধ্যে অনেক আসামী গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। অনেকে আতংকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ সংক্রান্ত অনেক জাতীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যার কয়েকটি নিম্নে বর্ণিত হলো।

প্রথম আলো
১ মার্চ ২০০০

শাহাজাদপুরে বোরকার পর এবার ভিক্ষুক আতংক

শাহজাদপুর প্রতিনিধি: বোরকা আতংকের পর এবার শাহজাদপুরে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের মধ্যে শুরু হয়েছে ভিক্ষুক আতংক। শাহজাদপুর থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার ওয়ারেন্টধারী আসামী, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের ধরতে ভিক্ষুক সেজে তার পুলিশ দল নিয়ে হানা দিচ্ছে। সোমবার স্থানীয় কয়েকজন ওয়ারেন্টধারী আসামীকে এভাবে গ্রেফতার করেছেন।

বাংলা বাজার পত্রিকা
১ মার্চ ২০০০

ভিক্ষুক-বোরকা আতংক
বোরকা আতংকের পর এলাকার সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দাগী আসামীদের মধ্যে এখন ভিক্ষুক আতংক বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে। এই থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার। ওয়ারেন্টধারী, দাগী আসামী, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে ও.সি সাহেব বর্তমানে তার দল নিয়ে হানা দিচ্ছেন ভিক্ষুক বেশে। কাজ হচ্ছে এতে। গত সোমবার স্থানীয় কয়েকজন দাগী আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন ও.সি এই বেশেই। এর আগে শাহাজাদপুর থানা পুলিশ বোরকা পরে বেশ কিছু দাগী আসামী ও চাঁদাবাজসহ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছেন। ফলে শাহাজাদপুরে এখন তীব্র বোরকা ও ভিক্ষুক আতংক বিরাজ করছে। শাহাজাদপুর সংবাদদাতা।

সাপ্তাহিক ধরণী
৫ মার্চ-১১ মার্চ ২০০০

শাহাজাদপুরের সন্ত্রাসীদের মাঝে ভিক্ষুক আতংক

শাহাজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা: সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের মধ্যে ভিক্ষুক আতংক শুরু হয়েছে। শাহজাদপুর থানার সফল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মির্জা গোলাম সারোয়ার ওয়ারন্টের আসামী, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের ধরতে ভিক্ষুক সেজে তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে হানা দিচ্ছেন। এর পূর্বে তিনি বোরকা পরে আসামী ধরার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বর্তমানে ঐ কৌশল পরিবর্তন করে ভিক্ষুক সেজে ওয়ারেন্টী আসামী ধরার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় কয়েকজন ওয়ারেন্টের আসামীদের এভাবে গ্রেফতার করেছেন বলে জানা গেছে।
শাহাজাদপুর থানায় থাকাকালীন সময়ে আসামীদের মাঝে সর্বত্র বোরখা এবং ভিক্ষুক আতংক বিরাজ করে। সন্ত্রাসীদের ধরতে এ ধরণের ছদ্মবেশ ধারণে দলমত নির্বিশেষে সকল মহলে প্রশংসিত হয়। বোরখা অভিযানের কথা সারাদেশে এতো ছড়িয়ে পড়ে যে, যেখানেই যেতাম, পরিচয় পাওয়ার পর আমার কাছ থেকে বোরকা অভিযানের কথা শুনতেন। এমনকি আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় অনেক বিজ্ঞ বিচারক মহোদয়গণ আমাকে বোরখা অভিযানের কথা জিজ্ঞেস করতেন। এ কারণে পুলিশ সুপার সহ অনেকেই আমাকে বোরখা ও.সি বলে ডাকতেন। অনেক সময় আমি দিনে কিংবা সন্ধ্যায় বাসা থেকে গোপনে বোরখা পরে রিকশা যোগে শাহাজাদপুর বাজার ঘুরে পলাতক আসামীদের চলাফেরা এবং গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতাম। যার ফলে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছিলাম। থানার অফিসার ও ফোর্সরা কখনই বিষয়টি টের পেতো না।
শাহাজাদপুর থানায় রাত্রিতে টহলে গিয়ে দেখতাম কোন রিকশায় বাতি নেই। ফলে রাস্তায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটতো। উপজেলার আইন শৃঙ্খলা মিটিং-এ নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হতো। দুর্ঘটনারোধে আমি ২০০০ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যের সময় শাহাজাদপুর পৌর এলাকায় হারিকেন অভিযান চালিয়ে ৫০০ রিকশা আটক করে থানার মাঠে রাখি। কোন রিকশাতেই হারিকেন ছিল না। এর মধ্যে ১৯২ জন রিকশাওয়ালাকে তাৎক্ষণিক হ্যারিকেন কিনে রিকশায় লাগাতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে শাহাজাদপুর পৌর বাজারে হারিকেন কেনার ধুম পড়ে দোকানগুলো থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সব হারিকেন নিঃশেষ হয়ে যায়। দোকানে শতশত রিকশাওয়ালা হারিকেন কিনতে লাইন ধরে। বিষয়টি এলাকায় দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং উপজেলা পরিষদ সহ সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এরপর থেকে শতকরা ৯৯ ভাগ রিকশাই হারিকেন ব্যবহার করতে দেখা যায়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। এতসংক্রান্ত খবর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যার কয়েকটি নিম্নরূপ:

ভোরের কাগজ
১১ জুলাই ২০০০

হ্যারিকেন কেনার ধুম
শাহাজাদপুর প্রতিনিধি: শাহাজাদপুর পৌর বাজারে হ্যারিকেন কেনার হিড়িক পড়লে দোকানগুলো থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায় সব হ্যারিকেন। গত ৫ জুলাই রাতে থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার ৫০০ রিকশা আটক করেন। এর মধ্যে ১৯২ রিকশাওয়ালাকে হ্যরিকেন কিনতে বাধ্য করা হয়। ফলে পর দিন ৬ জুলাই দোকানগুলোতে শত শত রিকশা ড্রাইভার হারিকেন কিনতে লাইন ধরে।

সংবাদ
৭ জুলাই ২০০০

হিড়িক
শাহাজাদপুর থেকে নিজস্ব সংবাদাদাতা: বিদ্যুৎ না থাকার কারণে নয়, পুলিশি অভিযানের ফলে শাহাজাদপুর পৌর শহরে হ্যারিকেন কেনার হিড়িক পড়েছে। পৌর বাজারের দোকানগুলো থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায় হারিকেন। গত বুধবার রাতে থানার ও.সি মির্জা গোলাম সারোয়ার প্রায় ৫ শত রিকশা আটক করে। এর মধ্যে ১৯২ জন রিকশা ড্রাইভারকে তাৎক্ষণিক হ্যারিকেন কিনতে বাধ্য করে। ফলে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দোকানগুলোকে শত শত রিকশাচালক হ্যারিকেন কিনতে ভিড় জমায়।
অপরাধ প্রবণ শাহাজাদপুর থানায় আসামী ধরতে কখনো বোরখা পরে, কখনো ভিক্ষুক বেশে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের বাড়ীসহ সব জায়গায় হানা দিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করে সফল অভিযানের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো হয়। আমাদের বহুমুখী অভিযানের ফলে আসামীরা দিশেহারা হয়ে স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। গ্রেফতারী পরোয়ানা তামিল নিয়ে জেলার মাসিক অপরাধ সম্মেলনে আমাকে আর কোন কথা শুনতে হয়নি। বরং এর কারণে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছি। চাকুরী জীবনে অপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য অনেক ধরণের অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছি। বিশেষ করে বোরখা ও ভিক্ষুক অভিযানের কথা সারাজীবন আমার স্মরণ হয়ে থাকবে। সাথে সাথে মনে থাকবে বোরখা অভিযানের কারণে স্ত্রীর সাথে তীব্র মনোমালিন্যের কথা। এখনো অনেকে আমাকে বোরখা অভিযানের কথা স্মরণ করিয়ে বোরখা ও.সি বলে ডাকেন। শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও ফিরে যাই স্মৃতিময় হারানো সেই দিনে।


লেখক: সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top