আজও অবহেলিত ভাষা আন্দোলনে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাজশাহী ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ নগরী। ১৯৪৮ সালেই রাজশাহীতে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরেছিল। এরপর ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে মোহন পার্কে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনারটি গড়ে ওঠে রাজশাহীতেই ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে, রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্র হোস্টেলের এফ ব্লকের সামনে। ঢাকার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজশাহীর ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। সে সময় রাজশাহী কলেজকে বলা হতো দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। এখানকার শিক্ষক ও ছাত্ররা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন। ফলে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ রাজশাহী কলেজ থেকে সমগ্র রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতেই গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, যেখানে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা নেতৃত্বে ছিলেন। তারা মিছিল, প্রচারণা ও সভার মাধ্যমে আন্দোলনকে আরও বেগবান করেন। ঢাকায় ছাত্ররা শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে রাজশাহীর ছাত্ররাও জড়ো হন নিউ হোস্টেলের সামনে এবং স্লোগানে মুখরিত করেন রাজশাহী 'শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না', 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'।
শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হন মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ছাত্র এস. এম. গাফফার। যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন রাজশাহী কলেজের সিনিয়র ছাত্র গোলাম আরিফ টিপু ও হাবিবুর রহমান। ২১ ফেব্রুয়ারির রাতেই লণ্ঠন, মশাল আর হারিকেনের আলোয় রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের মাঠে ছাত্ররা ইট ও কাদা দিয়ে তৈরি করেন দেশের প্রথম শহীদ মিনার। রাত ১টার দিকে কাজ শেষ হলে পালাক্রমে ছাত্ররা এটি পাহারা দেন। শহীদ মিনারের গায়ে লেখা হয় 'উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।'
রাজশাহী কলেজের মেধাবী ছাত্রদের হাতে নির্মিত এই শহীদ মিনারই ছিল দেশের প্রথম শহীদ মিনার, যা নির্মিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে, অথচ ঢাকায় শহীদ মিনার নির্মাণ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। পরদিন, ২২ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহীতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। রাজশাহী কলেজের লন টেনিস কোর্টে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যোগ দেন। তবে বিকেলে মুসলিম লীগ ও পুলিশের যৌথ আক্রমণে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলা হয়। আজও অবহেলিত প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে দেওয়া সেই শহীদ মিনারের স্মৃতিচিহ্ন আজও টিকে রয়েছে, তবে এখনও পর্যন্ত এটি কোনো স্বীকৃতি পায়নি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাজশাহী কলেজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বারবার উপেক্ষিত হয়েছে।প্রশ্ন থেকে যায় আমরা কি ভাষা শহীদদের যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছি? কেন এখনও দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল না? ২০২৫ সালের ভাষা দিবসে এই অবমূল্যায়িত শহীদ মিনারটির যথাযথ স্বীকৃতি হোক রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
নুসরাত নাঈম সাজিয়া
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী
আরপি/আআ
বিষয়: শহীদ মিনার অবহেলিত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: