মিশরে গণবিক্ষোভ : সিসির বিরুদ্ধে আরেক বসন্ত

আরব বসন্তের সময় মিশরের প্রেসিডেন্ট এবং দীর্ঘ ২০ বছরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন হয়েছিল। মোবারকের পতনের পর সামরিক বাহিনীর হাতে মিশরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল। বহু তালবাহানার পর সামরিক বাহিনী ২০১২ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলে দুই পর্বের ওই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রার্থী মুহাম্মাদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের একনিষ্ঠ লোক ছিলেন তিনি। সুতরাং ড. মুরসিকে আমেরিকা মেনে নিতে পারেনি। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার ক্লায়েন্ট স্টেট ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য মিশরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ড. মুরসিকে রাখা নিরাপদ নয় বলে মনে করেছিল।
প্রায় এক বছরের মাথায় সামরিক বাহিনীর হাতে ড. মুরসির পতন হয়। মিশরে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দেশরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে মিশরে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি গণহত্যার অপবাদে ড. মুরসির বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। জেনারেল সিসি মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে মুরসির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের হুকুম দিয়েছিলেন। গত আগস্টে আদালতে বিচার চলাকালে কারারুদ্ধ ড. মুরসির মৃত্যু হয়।
ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৮ সালে। তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাসান আল বান্না নামক জনৈক স্কুলশিক্ষক। তখন মিশরের ক্ষমতায় সুলতান ফুয়াদ। তারাই এই নিরীহ শিক্ষক হাসান আল বান্নাকে হত্যা করেছিল। ১৯৫৬ সালে কর্নেল জামাল আবদেল নাসের মিশরের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে অনুরূপ অভিযোগের ভিত্তিতে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বহু নেতাকে হত্যা করা হয়। সৈয়দ কুতুবেরও মৃত্যুদণ্ড হয় সেই সময়।
২০১৩ সাল থেকে জেনারেল সিসি মিশরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সব ধরনের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ছিল। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে জেনারেল সিসির বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে মিশরের বিভিন্ন শহরে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দ্বিতীয় সপ্তাহেও সিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত আছে। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন প্রদেশে আরোপিত কঠোর সুরক্ষাব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে সিসির পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে স্লোগান দেয়। টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে।
এদিকে, সিসির সমর্থকরাও তার পক্ষে সমাবেশ করছে, যেখানে জনপ্রিয় শিল্পীরা অংশ নেয়। নিরাপত্তা বাহিনী শুক্রবারের নামাজের পরপরই সীমিত বিক্ষোভ প্রদর্শনের অনুমতি দেয়ার কারণে বেশ কয়েকজন সেলিব্রিটি, জনসাধারণ এবং সংসদ সদস্য সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান শেষে সিসি ২৭ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন।
মিশরে সামরিক বাহিনীতে কাজ করা মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদার ভিডিও পোস্টে নয় কোটি মিশরবাসীকে জেনারেল সিসির বিরুদ্ধে মাঠে নামার জন্য আহ্বান জানান। তার অভিযোগ সিসি এবং তার সামরিক সরকারের ঘনিষ্ঠরা ‘দুর্নীতি ও জনসাধারণের তহবিল অপচয়’ করছেন। মোহাম্মদ আলী বর্তমানে স্পেনে রয়েছেন। সেনাবাহিনীর ঠিকাদার এবং বিলিওনিয়ার হিসেবে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো আঁতাত রয়েছে কি না এখনও স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে না। তবে মোহাম্মদ আলী দেশরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ জাকিরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জেনারেল সিসিকে গ্রেফতার করার জন্য।
এবারের বিক্ষোভ ২০১১ সালের আরব বসন্তের বিক্ষোভের অনুরূপ না হলেও তা যে একেবারে অবহেলা করা যায় তাও নয়। রাজধানীসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়েছে বিক্ষোভ। প্রায় দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে জেনারেল সিসি ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সময় ডেমোক্রেট, সেকুলার দেশের ১০ শতাংশ খ্রিস্টানদের সমর্থন পেয়েছিলেন। আর ক্ষমতায় এসে তাদের প্রতিও ভালো ব্যবহার করেননি। তিনি ইসলামপন্থীদের যেমন নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আবার গণতন্ত্রকামীদেরও নিরাপদ রাখেননি।
আল বারাদি, আহমদ শরীফ, হামাদি প্রমুখ গণতান্ত্রিক শক্তির নেতাদেরও হয়তো জেলে দিয়েছেন, না হয় দেশছাড়া করেছেন। এবারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য কারা অগ্রভাবে আছে তা এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে সফল হতে হলে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতারা নেপথ্যে থাকাই ভালো কারণ তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের ক্ষোভ রয়েছে। অবশ্য মুসলিম ব্রাদারহুড়ের সমর্থন রয়েছে তুরস্কের মতো মুসলিম দেশের। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসিপ তায়্যিপ এরদোগান মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসির বিরোধী। এবার জাতিসংঘ এক মধ্যাহ্নভোজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এক টেবিলে বসেননি তিনি কারণ সেই টেবিলে সিসি বসা ছিল আগে থেকে।
ট্রাম্পের সঙ্গে আবার সিসির খাতির বেড়েছে। ট্রাম্প তাকে প্রকাশ্যে তার প্রিয় একনায়ক শাসক বলেছেন। অন্যদিকে মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তুরস্ক সিসিকে দায়ী করেন। এরদোয়ান সিসিকে অত্যাচারী হিসেবেও চিহ্নিত করেন এবং তিনি যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নন তাও অনেকবারই উল্লেখ করেছেন। এরদোয়ান জানান, সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার বিষয়ে তুরস্ক যেমন সোচ্চার, তেমনি মুরসির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারটিও বিশ্ববাসীকে ভুলে যেতে দেবে না তুরস্ক।
জেনারেল সিসি ক্ষমতাসীন হয়েছেন প্রায় ছয় বছর হতে যাচ্ছে। তবে তার উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা নেই তার। সমগ্র আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল কিন্তু জেনারেল সিসির শস্য পরিমাণ সহানুভূতি নেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি। গাজায় অবরুদ্ধ ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি গাজা থেকে সিনাইয়ে আসা-যাওয়া করার জন্য ১৪-১৫টা সুড়ঙ্গ করেছিল। তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে আসা-যাওয়া করত এবং মিশরের সিনাই থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করত। জেনারেল সিসি ইসরায়েলের পরামর্শে সব সুড়ঙ্গ পথের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনিরা এই পথগুলো ব্যবহার করে নিরাপদে ভূমধ্যসাগরে আসা-যাওয়া করত। তারা ভূমধ্যসাগর থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন তারা সাগরে আসা-যাওয়া করে ইসরাইয়েলি সেনাদের বেষ্টনী ভেদ করে।
জেনারেল সিসির এই নির্মমতার কারণে তুরস্কের পাশাপাশি কাতার, ইরানও তার ওপর অসন্তুষ্ট। সিসি ক্ষমতায় আসার পর মিশরের বেকারত্ব বেড়েছে আর দারিদ্রতা ২৫ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশ হয়েছে। সুয়েজ খালের প্রশস্তকরণ ও রাজধানী স্থানান্তর কাজের মতো দুইটি বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নিলেও বেকারত্বের কিছুই হেরফের হয়নি। মিশরীয় অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলছে দীর্ঘদিনব্যাপী। এছাড়া বলা হচ্ছে জেনারেল সিসি হচ্ছেন ইহুদি মায়ের সন্তান। আরবরা এ বিষয়টা বক্রদৃষ্টিতে দেখে। যদিও তারা ইহুদি মেয়ে বিয়ে করার লোভ সংবরণ করতে পারেন না।
সবাই আশাবাদী জেনারেল সিসির পতন হবে কারণ জেনারেল সিসি মুসলিম উম্মাহ সাধারণ স্বার্থের প্রতি অনাসক্ত। আমেরিকার ক্লায়েন্ট স্টেট ইসরায়েলকে নিয়ে সমগ্র আরব দুনিয়া উদ্বিগ্ন। সুতরাং একজন ধর্মনিরপেক্ষ আরবিও ইসরায়েলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আর ইহুদিদের ঘৃণা করে থাকে। অথচ জেনারেল সিসি ইসরায়েলের হাতের পুতুল হয়ে রয়েছেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট থেকে কোনো আরব কখনো এমন আচরণ প্রত্যাশা করে না।
বিক্ষোভ যারা করছেন তাদের প্রতি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমর্থন রয়েছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা রাস্তায় নেমে জেনারেল সিসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহ দিচ্ছেন। মিশরীয় সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ জেনারেল সামি আনানের অনুগত মিসর অফিসার্স ফ্রন্ট বলেছে তারা বিক্ষোভকারীদের সুরক্ষা দেবেন। সেনাবাহিনী প্রকাশ্য সমর্থন শতাংশ পাওয়ার কথা বলেছি না তবে ২৫ শতাংশের সমর্থন পেলেও জেনারেল সিসির পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না। কারণ মিশরের নয় কোটি মানুষ বিক্ষুব্ধ। একটা গণঅভ্যুত্থানের জন্য সব রকমের পরিস্থিতি বিদ্যমান। বিক্ষোভ আরম্ভ হয়েছে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে জেনারেল সিসি পতন হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়ে কখনো কোনো দেশে কোনো স্বৈরশাসক টিকতে পারেনি। জেনারেল সিসিও হয়তো পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
আরপি/এএস
বিষয়: মিশর গণবিক্ষোভ আনিস আলমগীর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: