গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড কিট, বিজ্ঞান বনাম রাজনীতি
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনাভাইরাস শনাক্ত করার জন্য একটি কিট আবিষ্কার করেছে এবং তারা প্রেস কনফারেন্স করেছেন। সেখানে সরকারের কেউ যাননি। একজন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী হিসেবে এবং দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে সরকার ঠিক কাজটি করেছে। কেন? একটি ডায়াগনস্টিক কিট আবিষ্কার করে জনসাধারণের ব্যবহার করার জন্য আসুন দেখি বিজ্ঞানের মাঠে কি কি স্টেপ নিতে হয়।
১। আপনার গবেষণা দল ভাইরলোজি, ইম্যুনোলজি এবং ল্যাব সায়েন্স এর ভিত্তির উপর নির্ভর করে একটি কিটের প্রোটোটাইপ আবিষ্কার করবে।
২। তারা এই কিটটির কার্যকারিতা কিভাবে পরীক্ষা করা যায় সেটি নিয়ে একটি প্রটোকল লিখবেন এবং সেটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিবেন (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি Bangladesh Medical Research Council [BMRC]).
৩। সেই প্রটোকলটি আপ্রুভড হলে তারা বা থার্ড পার্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিটটির কার্যকারিতা নিয়ে একটি এপিডেমিওলজিকাল গবেষণা করবে।
৪। আপনি আপনার গবেষণার সকল তথ্য উপাত্ত নিয়ে Directorate General Drug Administration (DGDA) এর কাছে জমা দিবেন এবং সম্ভব হলে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশ করবেন।
৫। DGDA সকল তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে আপনাকে পারমিশন দিবে সেই কিটটি উৎপাদন এবং বাজারজাত করার।
এবার আসুন দেখি ডায়াগনস্টিক কিট আবিষ্কারের রাজনৈতিক ধাপগুলি কি কি?
১। আপনি শুরু থেকে সরাসরি দাবি করে বসবেন যে আপনার টেস্ট কিট শতভাগ কার্যকর। এটি কে কিনে নেবার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
২। কেউ যদি আপনার দাবি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তাহলে বলুন যে তারা নিজেরা পরীক্ষা করে দেখুক আমি সত্যি বলছি কিনা।
৩। জনমতকে আপনার ফেভাবে কাজে লাগান। এটা সন্দেহ নেই যে দেশে কিটের অভাব রয়েছে, সেটি নিয়ে বেশি বেশি কথা বলুন। মানুষের আবেগ, দেশপ্রেম এগুলি কাজে লাগান (যেমন: সাম্প্রতিক একটি ইন্টার্ভিউতে "বাংলাদেশি রক্ত" কথাটি প্রায় ৫-৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে।)
৪। আপনি সরকারের সিস্টেমের "ভিকটিম" হিসেবে দাবি করুন। সরকার আপনাকে পদে পদে বাঁধা দিচ্ছেন সেটি বলতে থাকুন।
৫। যেকোনো প্রকার আলোচনায় বা প্রেস কনফারেন্সে আপনার চিফ সায়েন্টিফিক অফিসারকে না পাঠিয়ে আপনি নিজে যান। বৈজ্ঞানিক আলোচনা পরিহার করুন।
মানুষজনকে বলুন এটি খুব এ সহজ একটি পরীক্ষা - অনেকটা প্রেগ্নেন্সি বা ডায়েবেটিস এর টেস্ট এর মত। সরকার কি আসলেই গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড কিট আবিষ্কারের শত্রু? না। গণস্বাস্থ্যের কিটের প্রধান সমস্যাগুলি কি আসুন তা বোঝার চেষ্টা করি।
১। র্যাপিড কিট এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল "ফলস নেগেটিভ"। অর্থাৎ একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে আপনি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলাফল ভয়াবহ কারণ আপনি তখন তাকে অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছেন।
২। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও এই ধরনের র্যাপিড কিট কার্যকর হয়নি। এইটাই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। অনেক চাইনিজ কোম্পানি দাবি করেছিল এবং সেগুলি কিনে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস এর মত দেশ ধরা খেয়েছে। একটু গুগল করে দেখুন, নিজেই বুঝতে পারবেন।
৩। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিছু কিছু ব্যাপার দাবি করেছে যেগুলি মারাত্মক ধরনের সায়েন্টিফিক মিসকন্ডাক্ট বা রিসার্চ ইথিক্সকে ভায়োলেট করে। যেমন: তারা বলেছেন তারা বিদেশ থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেছেন। যদি এটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এই পারমিশন তারা কোথায় পেয়েছেন। আবার তারা প্রাথমিক আবেদন পত্রে বলেছেন অ্যান্টিবডি টেস্ট করবেন, এখন তারা বলছেন যে অ্যান্টিজেন টেস্ট বের করেছেন। এই ধরনের অস্বচ্ছটা কিন্তু সায়েন্টিফিক মিসকন্ডাক্ট।
৪। যেহেতু র্যাপিড কিট দিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে কারো করোনা ভাইরাস আছে কি না, তাই পিসিআর টেস্ট করতে হবে নিশ্চিত হবার জন্য। গণস্বাস্থ্য যেহেতু এটি বাণিজ্যিক লাভের জন্য করছে, তাহলে র্যাপিড কিট এবং পিসিআর টেস্ট দুটি করার অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে?
দেখুন, আমি আশাবাদী মানুষ। আমি আমার বাজির দান গণস্বাস্থ্যের কিটের পক্ষেই রাখতাম যদি না তারা সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করতো। কিন্তু তারা বিজ্ঞানের মাঠে না খেলে রাজনীতির মাঠে খেলছে। এবং সেখানে সরকার রাজনীতির সঠিক চালটিই দিয়েছে। কারণ, সরকারের কেউ আজ থাকলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বলত যে আমরা তাদেরকে দিয়েছি এবং তারা সেটি আটকে দিয়েছেন। অর্থাৎ দোষ সরকারের ঘাড়েই আসতো। আসুন এই ক্রান্তিকালে রাজনীতি বাদ দিয়ে সঠিকভাবে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
লেখক: ডা. মো. সাজেদুর রহমান শাওন, পিএইচডি (ওক্সফোর্ড), এমএসসি (সুইডেন), এমবিবিএস (ডিএমসি), পোস্টডক্টোরাল এপিডেমিওলজিস্ট, ইউএনএসডাব্লু সিডনি।সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
আরপি/এমএইচ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: