রাজশাহী বুধবার, ১২ই মার্চ ২০২৫, ২৯শে ফাল্গুন ১৪৩১


একদিনের ভালোবাসা, নাকি ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা?


প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:১৯

আপডেট:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:২২

রাজশাহী পোস্ট

২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানে, শহীদ মিনারগুলোতে উপচে পড়ে ফুলের স্তূপ, আর ফেসবুক-টুইটার সেজে ওঠে ভাষা-আন্দোলনের গৌরবগাথায়। এই দিনটিতে সবাই ভাষার প্রতি তার 'বিশেষ ভালোবাসা' প্রকাশ করে, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ভাষা-প্রেম কি শুধুই ফেব্রুয়ারির জন্য? বছরের বাকি দিনগুলোতে কি এটি স্রেফ এক ধরনের ভণ্ডামি, যেখানে আমরা ভাষাকে শুধুই আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করি এবং তার প্রতি প্রকৃত দায়বদ্ধতা থেকে দূরে থাকি? ভাষার প্রতি আমাদের এমন মৌসুমি দরদ কোনো বাস্তবিক অনুভূতি নয়, বরং তা কেবল একটি সামাজিক ধারাবাহিকতার অংশ। ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখানোর ঢঙে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, সেলফি তোলা—এগুলো কেবল ‘একদিনের’ বাহ্যিক প্রকাশ। তারপরে, ২২ ফেব্রুয়ারি আবার পুরোনো ভুল বানানে লেখা শুরু হয়। এটা কি সত্যিকার ভাষা-প্রেম, নাকি কেবল সামাজিক চাপের অংশ? এক মাসের জন্য এসব আচরণ আমাদের হৃদয়ের গভীরে ভাষার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ব্যক্ত করে না, বরং এটি হয় নিছক সমাজের মধ্যে 'নির্ধারিত সময়' উদযাপনের অংশ।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন: “উর্দু, এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এটি ছিল একটি জাতীয় আত্মপরিচয়ের চ্যালেঞ্জ, যা বাঙালির অস্তিত্বের লড়াইয়ের মধ্যে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালে, ছাত্রদের প্রতিবাদের ফলে শহীদ হয় ১১ জন বাঙালি, যারা মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। সেই ঘটনা শুধুমাত্র এক কাল্পনিক ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং সারা পৃথিবীজুড়ে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের কাহিনি হয়ে উঠেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনার, ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি—এসব আজও আমাদের হৃদয়ের অংশ। কিন্তু আজ, ৭০ বছর পর, এই শহীদের রক্ত কি কেবল শহীদ মিনারের বেদিতে আটকে আছে? আমরা কি সেই রক্তের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, নাকি প্রতিদিনের ভাষাচর্চায় নিজেদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছি? ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা দিবস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়, কিন্তু মার্চে এসে সেই আলোচনাগুলো বিলীন হয়ে যায়। দেশের প্রথম সারির সব পত্রিকাগুলো ফেব্রুয়ারিতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে, টেলিভিশনে ভাষা-আন্দোলনের অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু তারপর সব যেন নিঃশব্দ হয়ে যায়। অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভাষা নিয়ে এত অশুদ্ধতা ও অবহেলা চলছে যে, ভাষার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রশ্নই ওঠে।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের ভাষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মধ্যে মাতৃভাষার ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে, প্রশ্ন ওঠে—কীভাবে আমরা বছরের ১১ মাসে এই অবহেলা মেনে নিয়ে ভাষার প্রতি আগ্রহ দেখাই শুধু ফেব্রুয়ারিতে? বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অফিসে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে না। ভাষার প্রতি সম্মান, তার রক্ষণাবেক্ষণ—এসব সম্পর্কে আমরা তেমন সচেতন নই। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, “যদি বাঙালি তার ভাষা ভুলে যায়, তবে তার আত্মা হারিয়ে যাবে।” আমরা কি সেই আত্মাহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি? যেখানে সরকারি অফিসের নেমপ্লেট, নথিপত্র, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার দেখা যায় না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ৩৭টি বানান ভুলসহ প্রকাশ করেছিল, যা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ভাষার প্রতি অশুদ্ধ ব্যবহার এবং উদাসীনতার স্পষ্ট উদাহরণ।

ফেব্রুয়ারি এলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাষা-আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার, সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। তবে, প্রশ্ন হচ্ছে—এটা কি সত্যিকারের ভাষা-প্রেম, নাকি শুধুই কিছু দিনব্যাপী সামাজিক প্রচেষ্টা? ২২ ফেব্রুয়ারি এলেই কি সেই ‘ভাষা-প্রেম’ শেষ হয়ে যায়? আমরা কি ভুলে যাচ্ছি, ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া শহীদদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব? ফেব্রুয়ারির ভাষা-প্রেম যদি আমাদের একদিনের প্যাশন’ হয়, তবে আমরা সেই শহীদদের প্রতি গুরুতর অবমাননা করছি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন। ভাষার আন্দোলন ছিল কেবল একটি দিনের ঘটনা নয়, এটি ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হওয়া উচিত। ভাষার প্রতি এই দায়বদ্ধতা, শ্রদ্ধা ও সচেতনতা আমাদের ৩৬৫ দিন পালন করতে হবে। ফেব্রুয়ারি শুধু আমাদের ঘুম ভাঙানোর ঘণ্টা হতে পারে, কিন্তু ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা ৩৬৫ দিনই আমাদের বহন করতে হবে। যদি তা না করি, তবে ভাষা-প্রেম কেবল একটি সামাজিক প্রতারণা হয়ে থাকবে। ফেব্রুয়ারির একদিনের জন্য আমরা ভাষার প্রতি যতটা ভালোবাসা দেখাই, তাতে যদি বাকি দিনগুলোতে ভাষা ব্যবহারের প্রতি উদাসীন থাকি, তবে সে ভালোবাসা একদিনেরই প্রতারণা হয়ে যাবে। ভাষার প্রতি বাস্তবিক দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ভাষার শুদ্ধতা, সততা এবং সম্মান অবশ্যই প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

 

মোছা. রোকেয়া সুলতানা

ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top