বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব

"ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত" কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই বাণীটি বসন্তকে আলিঙ্গনের আহ্বান জানায়। বাংলা পঞ্জিকাবর্ষ অনুযায়ী বসন্ত হচ্ছে ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। এর আগমন ঘটে শীত চলে যাওয়ার পর এবং গ্রীষ্ফ্ম আসার আগে। বসন্ত ঋতুতে শীতের শুস্কতায় বিবর্ণ প্রকৃতি ফিরে পায় প্রাণ, প্রকৃতিকন্যা নতুনরূপে সেজে ওঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে সব গাছ। আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং প্রকৃতিতে নতুন মাত্রা যোগের কারণে বসন্ত 'ঋতুরাজ' নামে পরিচিত। বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি খুলে দেয় দক্ষিণ দুয়ার। সে দুয়ারে বয়ে যায় ফাগুনের হাওয়া। বসন্তের এই দক্ষিণা হাওয়ায় মেতে ওঠে চারদিক।
গাঁদা, মালতী, চন্দ্রমল্লিকা, মাধবী, বকুল, শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রক্তকাঞ্চন, দেবদারু, নাগেশ্বর, অশোক, ইউক্যালিপটাস, গামারি, মহুয়া, শাল, ক্যামেলিয়া ইত্যাদি ফুল ফোটে এ সময়। শীতের খোলসে ঢুকে থাকা এসব ফুল যেন এই বসন্তে এক অলৌকিক স্পর্শে জেগে ওঠে। আমের মুকুলের সৌরভে ম-ম করে আকাশ-বাতাস। আর গাছে গাছে পাতার আড়ালে লুকিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে ডেকে আকুল হয় বসন্তের দূত কোকিল। পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই এ ঋতুতে ফুল ফুটে, নতুন গাছের পাতা গজায় এবং নতুন গাছের জন্ম হয়। এই বসন্তে অনেক পশুপাখি মিলন ঘটায় এবং বাচ্চার জন্ম দেয়। আবার পৃথিবীর অনেক জায়গায় এ সময় বৃষ্টিও হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গাছপালা বেড়ে ওঠে এবং ফুল ও ফলের পরবর্তী বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বসন্ত ঋতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গাছে গাছে কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও বসন্তের দোলা লাগে, হৃদয় হয় উচাটন। সব কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, সব বিভেদ ভুলে এবং নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। আগুন রাঙা এ বসন্ত প্রকৃতিতেই শুধু উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, রং ছড়ায় প্রতিটি তরুণ প্রাণে। প্রাণের টানে আর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মন হয়ে ওঠে উত্তাল, বাঁধনহারা।
বসন্ত নিয়ে তরুণদের উচ্ছ্বাসই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিনটিকে আমরা নানাভাবে বরণ করে নিই। বসন্তকে বরণ করার প্রধান অনুষঙ্গ হলো ফুল। দেশের বৃহত্তম ফুলের বাজার শাহবাগ, কাঁটাবনসহ বিভিন্ন ফুলের দোকানগুলোতে জমে ওঠে ফুলের রমরমা ব্যবসা। গাঁদা, রজনীগন্ধা, বেলি ও গোলাপের চাহিদা এ সময় সবচেয়ে বেশি থাকে। তরুণীরা চুলে খোঁপা বেঁধে ফুল জড়িয়ে, কেউবা ফুলের মালা দিয়ে বেণি করে, ফুলের বিভিন্ন অলঙ্কারে সেজে ঘুরতে বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, টিএসসি, চারুকলাসহ রমনা, ধানমন্ডি লেকের চত্বর এবং বিভিন্ন স্থানগুলো বাসন্তী বা হলুদ রঙের শাড়ি পরা নারী ও বিভিন্ন রঙের ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে। অসংখ্য নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণী বসন্তের উৎসবে মেতে ওঠে। তরুণীরা হলুদ-লালচে শাড়ির সংমিশ্রণে কপালে টিপ, হাতে চুড়ি, পায়ে নূপুর দিয়ে নিজেদের প্রকৃতির সঙ্গে সাজিয়ে তুলে। ছেলেরাও সাদা পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর শিশুরা রং-বেরঙের পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে তোলে।
বসন্তকাল কবি ও সাহিত্যিকের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। বিভিন্ন কবিতা ও গানে বসন্ত ঋতুকে কতভাবেই না তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে, কোরো না বিড়ম্বিত তারে।' কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- বসন্ত মুখর আজি, দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে, বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি। জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়' সহজেই মনে দাগ কেটে যায়। তাই তো সহজেই বলা যায় বসন্ত মানে পূর্ণতা, নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত এলে বিপুল তরঙ্গে আন্দোলিত হয়ে ওঠে বাঙালি মন। সবচেয়ে বড় কথা, বসন্ত এখন হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য উৎসব। বসন্তের আগমনে বিভিন্ন সংস্কৃতি অঙ্গনও এখন মুখরিত হয়ে ওঠে। সব কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। কোকিলের কুহুতান, দক্ষিণা হাওয়া, ঝরা পাতার শুকনো নূপুরের নিক্কন, প্রকৃতির মিলন- সবই এ বসন্তে। বসন্ত মানেই পূর্ণতা, বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব।
নুসরাত নাঈম সাজিয়া
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।
আরপি/আআ
বিষয়: বসন্ত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: