রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


নুসরাত, তুমি দেখতে পাচ্ছ কি?


প্রকাশিত:
২৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৯:০০

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪৮

ছবি: হাবীবাহ নাসরীন

প্রিয় নুসরাত!


তোমার মৃত্যুর পর ছয় মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে । তুমিহীন পৃথিবীতে আমরা এখনও বেচেবর্তে আছি। সেই গ্রীষ্ম পার হয়ে এখন শীত আসি আসি করছে। এইসব হিম হিম দিনে আমরা আরও খানিক উষ্ণতা খুঁজে বেড়াই। উদাস জানালায় চেয়ে অসময়ের বৃষ্টি দেখি। এইসব দেখার কথা ছিল তোমারও। বেঁচে থাকলে তুমিও কি এমন বৃষ্টির দিনে মায়ের হাতের খিচুড়ি খাওয়ার বায়না ধরতে? সারাদেশে তোমার বয়সী ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য লড়ছে এখন। যে লড়াইয়ে অংশ নেয়ার কথা ছিল তোমারও। অথচ তোমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে জীবন নামের লড়াইয়ে। কিছু অমানুষের লালসা তোমাকে বাঁচতেই দিল না!

নুসরাত জানো, তোমার আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে প্রতিটি মোনাজাতে কেবল তোমার মৃত্যু কামনা করেছি। যখন রাঁধতে গিয়ে হাত সামান্য পুড়িয়ে ফেলি, কী ভীষণ মনে হয় সেই যন্ত্রণা! অথচ তুমি পুড়ে যাওয়া সমস্ত শরীর নিয়েও লড়েছ চার চারটি দিন! কী অমানুষিক কষ্ট দিয়েই না ওরা তোমাকে মেরেছে! তুমি মায়ের কাছে পানি খেতে চেয়েছো বারবার। মায়ের চোখের পানিতে সমুদ্র বয়ে গেলেও এক ফোঁটা পানি তোমাকে খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। এইসব কষ্ট মা কী করে ভুলবে! তোমার তো মৃত্যুতে মুক্তি মিলেছে, কিন্তু মায়ের কান্না যে আজীবন।

নুসরাত, তোমার অপরাধ ছিল তুমি লড়াকু। তুমি নিজের সম্মান নিয়ে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলে। তুমি চেয়েছিলে বিচার হোক। কিন্তু ওইসব অমানুষদের যে লড়াকুদেরই ভয়! তুমি বেঁচে থাকলে ওদের মুখোশ খুলে যাবে, ক্ষমতার দম্ভে ন্যায়হীনতার রাজত্ব গড়ে তুলতে পারবে না বলেই ওরা তোমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা জানে না, এদেশে ওদের মতো অমানুষের চেয়ে এখনও মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাইতো তোমার হত্যার বিচারের দাবিতে মানুষেরা এখনও পথে নামে। তাইতো তোমার মৃত্যু যন্ত্রণা আর মৃত্যুর কথা শুনে আমাদের চোখেও অশ্রু ঝরে।

বোন আমার, বড় হতে হতে আমিও জেনে এসেছি একজন লড়াকু মেয়েকে কতটা শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কত অসভ্য চোখ এড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে চলতে হয়। টিকে থাকতে হলে একজন মেয়েকে কতটা চোরাবালিতে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! তুমি জীবনের কাছে হেরেছো তবে জিতে গেছ তোমার টিকে থাকার লড়াইয়ে। জীবন দিয়ে হলেও মুখোশ খুলে দিয়ে গেছ কিছু মানুষের মতো দেখতে অমানুষের।

নুসরাত, জান্নাতের কোন বাগানে এখন তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ আমি জানি না। সেই অসীম দূরত্বে থেকে কি তুমি আমাদের এই ক্ষুদ্র পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছ? তুমি কি পড়তে পারছো আমার এই ছোট্ট চিঠি? জানো নুসরাত, আজ আমাদের পৃথিবীতে বড় আনন্দের দিন। তোমাকে যারা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল তাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে আজ। তোমার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ আরও অনেকটা প্রশস্ত হলো।

প্রিয় বোন, আজ কি তোমাদের বেহেশতেও আনন্দ হচ্ছে খুব? পৃথিবীর এইসব তুচ্ছ আনন্দ-বেদনা কি তোমাদেরও স্পর্শ করে? নাকি যেমন একবুক যন্ত্রণা আর অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছ, তেমনই ঘৃণা পুষে রেখেছো এখনও? ঘৃণাটুকু মুছে ফেলো বোন। তোমাদের অভিশাপে আমরাও যে ভালো থাকতে পারছি না। খুনের মিছিলে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে নতুন সব নাম। নতুন সব কষ্টে আমরা নুয়ে পড়ছি। আমরা স্বপ্ন দেখার সুযোগটুকুও পাচ্ছি না। গুছিয়ে লেখার, পৃথিবীকে নতুন করে দেখার সাধটুকুও দিনে দিনে মিইয়ে যাচ্ছে। তোমার অভিশাপ মুছে ফেলো বোন। তোমার খুনিদের ফাঁসির মাধ্যমে পৃথিবী যেন নতুন দিনের মুখ দেখে। সেইসব দিনে আর কোনো নুসরাত দগ্ধ হবে না। আর কোনো মা সন্তান হারানোর কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাবে না। আর কোনো সিরাজ উদ দৌলা চোখ তুলে তাকানোরও সাহস করবে না।

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top