রাজশাহী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


অভিনব কায়দায় লাখ লাখ টাকা লোপাট প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার


প্রকাশিত:
৮ এপ্রিল ২০২১ ০২:২৩

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:১৭

ছবি: সংগৃহীত

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্পের আওতায় খামারিদের সহায়তা প্রদানের নামে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্রের বিরুদ্ধে। একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে সুকৌশলে খামারিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার আশ্রয়ে এই চক্রের সাথে জড়িত রেজিস্ট্রেশনবিহীন কথিত ভেটেরিনারি ডাক্তার, এলাকার প্রভাবশালী ও ফড়িয়ারা। সরকারি সহায়তার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারির কাছ থেকে অভিনব উপায়ে টাকা আদায় করা হয়েছে।

খামারভেদে প্রত্যেকের কাছে নেয়া হয়েছে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার নামে এসব টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা এবং উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, ১৪টি ইউনিয়নে খামারিদের মাঝে সিন্ডিকেটের নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে চালানো হয়েছে প্রচারণা। কারো কাছে সরকারিভাবে খামার রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আবার কারো কাছে প্রণোদনা সহায়তার ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার প্রলোভন দেখানো হয়েছে। শুধুমাত্র প্রলোভনে কাজ না হলে দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি।

গত বছরের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসব টাকা নেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রণোদনা সহায়তার ৩০ হাজার টাকা খামারিদের বিকাশ একাউন্টে ঢুকে যাবে। ফলে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত প্রান্তিক খামারিরা নিজ উদ্যোগে স্থানীয় প্রভাবশালী, পরিচিত ভেটেরিনারি ডাক্তারের মাধ্যমে টাকা জমা দেয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্রের কাছে। ১৪-১৫ জন এজেন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন এই কর্মকর্তা।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চার লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ খামারিকে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী এই টাকা পাওয়ার জন্য খামারিদের কোন অর্থ পরিশোধ করতে হবে না।

সরকারি রেজিস্ট্রেশন বিহীন কিংবা রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারিরা এই অর্থ পাবেন। কোন অর্থ গ্রহণ না করার কড়া নির্দেশনা থাকা স্বত্তেও শত শত খামারির পকেট কেটেছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য।

প্রণোদনার টাকা খামারিদের কাছে পৌঁছালেও তাদের প্রদেয় টাকা কোথায় এ সম্পর্কে বেমালুম জানেন না খামারিরা। খামার রেজিস্ট্রেশনের নামে যাদের কাছে টাকা নেওয়া হয়েছিল দীর্ঘ ৭-৮ মাস পেরিয়ে গেলেও খামার রেজিস্ট্রেশনের নাম নেই। আবার অনেক খামারি টাকা দিয়েও পাননি প্রণোদনার একটি টাকাও! টাকা ফেরৎ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সেসব খামারিরা। এ নিয়ে প্রাণিসম্পদ দফতর থেকে মিলছে না কোন সদুত্তর।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে কথা হয় উপজেলার তেঁতুলিয়া, ভারশোঁ, কালিকাপুর এই তিন ইউনিয়নের টাকা তোলার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন এজেন্টের সাথে। এদেরই একজন ১১ নং কালিকাপুর উনিয়নের ভেটেরিনারি চিকিৎসক দুলাল হোসেন।

তিনি বলেন, ‘আমি ২ হাজার টাকা করে মোট ৯৭ জনের কাছে থেকে টাকা তুলেছি। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা স্যার আমাকে এভাবে টাকা তুলতে বলেছেন; তাই তুলেছি। আমার চেয়ে বেশি টাকা তুলেছেন খালেক ভাই (আরেক ভেটেরিনারি চিকিৎসক)। ডিসেম্বরের মধ্যেই খামারিদের প্রণোদনা দেয়া হবে বলে এসব টাকা তোলা হয়েছে। আমি এখন টাকা পয়সা নিয়ে কোন ঝামেলার মধ্যে যেতে চাই না। এখন পর্যন্ত কোন রেজিস্ট্রেশনের কাগজ আমি পাইনি। আমার কোন দোষ নেই। যা বলার স্যারকে বলুন। আমি এসবের কিছু জানিনা। টাকা পয়সার হিসাব সব স্যার জানে।’

কথা হয় ১১ নং কালিকাপুর ইউনিয়নের চক উদয়নারায়ন গ্রামের মাসুদ রানার সাথে। ভুক্তভোগী এ খামারি বলেন, “প্রণোদনার টাকা পাওয়া যাবে প্রতিশ্রুতিতে গত বছরের অক্টবরের দিকে ২ হাজার টাকা নিয়েছে। পরে ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ হাজার টাকা মোবাইলে আসে। কিন্তু খামার রেজিস্ট্রেশন হয়নি, কোন কাগজ পাইনি। রেজিস্ট্রেশন হতে তো আর ৬-৭ মাস লাগে না। প্রণোদনার টাকা পেতে টাকা লাগে কি না জানতে চান এই খামারি।”

এই ইউনিয়ন থেকে প্রায় শতাধিক খামারির কাছে টাকা নেওয়া হয়েছে। টাকার বিষয়ে কাউকে না জানাতে দেওয়া হয়েছে হুমকি। একই ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের চকরঘুনাথ গ্রামের লেয়ার খামারি সাইদুর রহমান বলেন, মোবাইলে ১০ হাজার টাকা এসেছে। খামার রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে কিছু জানিনা। টাকা নেওয়ার সময় বলেছিল, প্রণোদনার টাকা না পেলে এই টাকা ফেরৎ দেওয়া হবে। এতো কিছু মারপ্যাঁচ তো আমরা বুঝি না।

উপজেলার ৯ নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সাটইল গ্রামের পোল্ট্রি খামারি আবুল হোসেন বলেন, “করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সরকার টাকা দিবে এই বলে সবার কাছে থেকে আড়াই হাজার করে টাকা নিয়ে গেছে। এই এলাকার যতগুলো খামারি আছে; পোল্ট্রি, ডেইরি, ব্রয়লার, হাঁস, ছাগল; সবার কাছে টাকা নিয়েছে। খামার রেজিস্ট্রেশনের জন্য আগে গিয়েছি তখন দেয়নি। আর এখন প্রণোদনার টাকা পাওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন লাগবে, তাই বলেছে পিড়কোর বাজারের পশু চিকিৎসক ছানোয়ারুল হক।”

৭ নং প্রসাদপুর ইউনিয়নের জোতবাজার (সরদারপাড়া) গ্রামের পোল্ট্রি খামারি আব্দুল জলিলের কাছে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার টাকা। তাকে প্রণোদনা ও খামার রেজিস্ট্রেশনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, “আমার এখানে টাকা তুলেছে পশু ডাক্তার সুমন। আমি তাঁর হাতে ২ হাজার টাকা দিয়েছি। সরকার নাকি আমাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু সাহায্য করবে। শুনলাম অনেকেই টাকা পেয়েছে। আমি কোন টাকা পাইনি। কোন রেজিস্ট্রেশন হয়নি। জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে গেছে। দফায় দফায় এসব পশু চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে বেশিরভাগ সময় তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। কয়েকবার চেষ্টার পরে কথা হয় পশু ডাক্তার আব্দুল খালেকের সাথে।

তার বিরুদ্ধে শতাধিক খামারির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। টাকা উত্তোলনের কথা আংশিক স্বীকার করে তিনি বলেন, “আমাকে স্যার (প্রাণিসম্পদ কর্মকতা) হুকুম করেছেন তাই টাকা তুলেছি। আমি ২৩-২৪টি খামারির টাকা তুলেছি।”

প্রণোদনার দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার সরকারি কোন নীতিমালা নেই। রেজিস্ট্রেশনের নামে অবৈধভাবে খামারিদের কাছে টাকা নেওয়া হলেও অনেক খামারি টাকা পাননি। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী খামার রেজিস্ট্রেশন করার জন্য নির্ধারিত ফি খামারি নিজে ব্যাংকে টাকা জমা দিবে। এই টাকা কেউ নিতে পারবে না।

অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিমাণ্য চন্দ্র বলেন, “মিডিয়ার বিরুদ্ধে রেস্ট্রিকশন রয়েছে। উর্দ্ধতন কর্মকর্তার হুকুম ছাড়া কোন তথ্য দেওয়া যাবে না। আপনি এসে দেখা করেন। আমি কোন তথ্য আপনাকে দিতে পারব না। তথ্য পাওয়ার জন্য ফরম পূরণ করে দিলে আমরা চিন্তা করে দেখব তথ্য দেওয়া যায় কি না!”

প্রান্তিক খামারিদের কাছে থেকে প্রণোদনার নামে টাকা নেওয়ার বিষয়ে কথা হয় নওগাঁ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন,“ এভাবে টাকা নেওয়ার কোন নিয়ম নেই। যদি কোন খামারির কাছে থেকে টাকা নেওয়া হয়ে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনারা তালিকা দেন আমি যথাযত ব্যবস্থা নিব।”

উল্লেখ্য, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের প্রণোদনা দেয়ার আশ্বাস দেয় বিশ্বব্যাংক। এজন্য প্রকৃত খামারিদের তথ্য সংগ্রহের পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের চার লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ খামারিকে টাকা প্রদান করে। সর্বনিম্ন ১০ হাজার ও সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পান খামারিরা। রেজিস্ট্রেশনভূক্ত ও এর বাইরের খামারিরাও এই আর্থিক অনুদান প্রাপ্তির যোগ্য। কিন্তু এই সুক্ষ কারচুপির মাধ্যমে খামারিদের পকেট কাটে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।


আরপি / এমবি-১৬



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top