রাজশাহী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


এত করোনার প্রকোপ যুক্তরাষ্ট্রে কেন?


প্রকাশিত:
৮ মে ২০২০ ১৭:১৫

আপডেট:
৮ মে ২০২০ ১৭:১৮

 

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমেরিকার চিত্র। যা বিশ্বে রেকর্ড গড়েছে। সারাবিশ্বে এ মুহূর্তে ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সেখানেই সবচেয়ে বেশি। গত এক শতাব্দীতে আমেরিকার এমন নাজুক পরিস্থিতি হয়নি।

আমেরিকার প্রতিটি স্টেটেই করোনাভাইরাস থাবা বসিয়েছে। মানুষ ঘরবন্দি। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশে এত বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে, মারা যাবে এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

চিকিৎসা ব্যবস্থা এত উন্নত, অর্থনীতি এত উন্নত তারপরও এ অবস্থা কেন? এই প্রশ্ন জাগছে মানুষের মনে। এই প্রশ্ন জাগা খুব স্বাভাবিক। এমন কি আমি নিজেও যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থেকে ভাবতে পারিনি এমন পরিস্থিতি হবে।

চীনের উহানে যখন প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে তখনও যুক্তরাষ্ট্র ভাবেনি এমন পরিস্থিতি হবে। উহানে করোনাভাইরাস যখন দ্রুতই বেড়ে চলেছে, লকডাউন করছে এবং উহান থেকে ইরান, ইতালি যখন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল তখনও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটগুলো চালু ছিল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে।

অবাধে চলার সুযোগ-সুবিধা ছিল, এমন কি এয়ারপোর্টে তেমন সতর্কমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে বিভিন্ন ফ্লাইটে চীন, ইরান, ইতালি থেকে আসা নাগরিক আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে অবস্থান করেছে। এর সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক হবে।

কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য, কেউ ভিজিট করতে, কেউবা এখানকার ইমিগ্রেন্ট ছিল, বেড়াতে গিয়ে ফিরে এসেছে আমেরিকায়। আর ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেহেতু সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পায় না, তাই অনেকে ভাইরাস শরীরে বহন করলেও নিজেই বুঝতে পারেনি সে আক্রান্ত।

আমেরিকা প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে ওয়াশিংটনে। তারপর নিউইয়র্ক ম্যানহাটনে। এই ম্যানহাটনে যার প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল সে ছিল একজন সেবিকা, ইরানে বেড়াতে গিয়েছিল তিনি। ফিরে আসে নিউইয়র্কে। সে নিজেও জানত না ভাইরাসে আক্রান্ত।

সিম্পটম দেখা দেয়ার পর বুঝতে পারে সে আক্রান্ত এবং হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যান। ততদিনে আস্তে আস্তে দু-একজনের সিম্পটম দেখা দেয় এবং রিপোর্ট আসে পজিটিভ। তখনও নিউইয়র্ক লকডাউন করা হয়নি। সাবওয়ে চলছে, স্কুল খোলা, অফিস খোলা আর গ্রোসারি তো আছেই। আমরা জানি, নিউইয়র্ক ঢাকা শহরের মত ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে বারো রকম মানুষের বসবাস।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বাস করে। কেউ ইমিগ্রেন্ট, কেউ ননইমিগ্রেন্ট। বলা হয়ে থাকে নিউইয়র্ক ঘুমায় না, জেগে থাকে। মানুষ ছুটে চলে দিনরাত। ফলে খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনের সংস্পর্শে এসে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে যায়।

দেখা যায় যে, গ্রোসারিতে যে ক্যাশিয়ার আক্রান্ত হল সে যখন একশত কাস্টমার হ্যান্ডেল করে একদিনে সেখান থেকে সেই একশত কাস্টমারও আক্রান্ত হয়ে যায়। যে মসজিদে জামাতে নামাজে গিয়েছে সেখান থেকেও আক্রান্ত হয়েছে। সাবওয়ে থেকেও আক্রান্ত হয়েছে। আর আড্ডা তো আছেই। বিভিন্ন প্রোগ্রাম তো আছেই।

ক্যাব, উবার থেকে কাস্টমার এবং ক্যাব চালকও আক্রান্ত হয়েছেন। সেখানে থেকে এটা এত দ্রুত ছড়িয়ে যায় সুপ্তভাবে যা আক্রান্তকারী নিজেরাও জানে না। যারা জনসমাগমে চলাচল বেশি ছিল তারাই আক্রান্ত হয়েছে ভাইরাসে। ঘনবসতি হওয়ার ফলে ভাইরাস এত দ্রুত ছড়িয়েছে যে দিনে কয়েক শত শত আক্রান্ত হয়েছেন।

যখন দুই সপ্তাহ পর দেখল রোগী একই সিম্পটম নিয়ে হাসপাতালে আসতে শুরু করে, তখন টনক নড়ে মেয়র ও গভর্নরের। তখন লকডাউন করে দেয়। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। দেখা যায় একই পরিবারের সবাই আক্রান্ত এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তারা কেউ বাদ যায়নি ভাইরাস থেকে।

প্রশ্ন হচ্ছে নিউইয়র্ক এ অবস্থা, তাহলে অন্য স্টেটে কী করে হলো? নিউইয়র্কের পরেই নিউজার্সিতে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বেশি (যেখানে আমি থাকি)। এর মূল কারণ হলো, অনেকে নিউইয়র্ক থেকে বাজার করে। যেমন আমি প্রায়ই যেতাম। অনেকের অফিসের কাজ থাকে, অনেকে বেড়াতে যায়। যেহেতু পাশাপাশি স্টেট, অনেকটা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মত। তাই অবাধে সবার আসা যাওয়া। ঠিক ওই সময় অর্থাৎ মার্চের প্রথম সপ্তাহে যারাই নিউইয়র্কে গিয়েছে অনেকেই সেখান থেকে আক্রান্ত হয়েছে।

এমনও হয়েছে নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সিতে অনেকে এসেছে কাজে তাদের কাছ থেকেও অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যান্য স্টেটে ইতালি, ইরান থেকে ফ্লাইটে আসা, নিউইয়র্ক থেকে আসা যাওয়া এভাবেই ছড়িয়ে যায়।

মূল বিষয়টা হলো, প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি তেমন। কিন্তু যখন একই দিনে হাসপাতালে একাধারে রোগী ভর্তি হতে থাকে তখন বুঝতে পারে যে ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে সুপ্তভাবেই।

তখনই শুরু হলো কীভাবে সামাল দেয়া যায় এই প্রসেস। শুরু হয় টেস্ট আর টেস্ট এবং টেস্ট করে যারা আক্রান্ত তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠায়। যারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাদের হাসপাতালে রেখে ভেন্টিলেটর দিতে থাকে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরও আর পাওয়া যায় না।

আর এত রোগী সামাল দিতে গিয়ে ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল স্টাফও আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অবস্থা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখনই স্টেট ইমারজেন্সি ঘোষণা করে। কিন্তু সর্বনাশা ভাইরাস ততদিনে থাবা বসায় অনেকে পরিবারে। কেড়ে নেয় একি পরিবারের এক-দুইজন করে। দেখা যায় লাশের সারি।

হাসপাতাল, ফিউনারেল হোম হিমশিম খেতে থাকে সামাল দিতে গিয়ে। তখন অন্যান্য স্টেট সতর্ক হয়ে যায়। তারাও প্রস্তুতি নিতে থাকে। ফলে নিউইয়র্কের তুলনায় আমেরিকার অন্য স্টেটে অনেক কম আক্রান্ত ও মৃত। সহজ কথায় যদি বলি, প্রথম দিকে অনেকে এতটা সতর্ক ছিল না।

আড্ডা দিয়েছে, বাজারে গিয়েছে নিজেদের মত। ভাবছে এটা ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু এর মত হবে। অনেকে আবার সতর্ক ছিল কিন্তু জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হয়েছে, ফলে আক্রান্ত হয়েছে। তারা ছিল নিরুপায়। পরিবারের কথা ভাবতে গিয়ে কাজে গিয়েছে।

যদিও গবেষকরা বলে আসছিল, এই ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে বিশ্বময়। তাদের কথা গুরুত্ব পায়নি। গবেষকরা বলেছিল আমেরিকা ১০-১২ লাখ আক্রান্ত হবে এবং মারা যেতে পারে ৮০–৯০ হাজার মানুষ। এ কথা শুনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, তারা বাড়িয়ে বলছে। এমনটা হতেই পারে না। কিন্তু তাদের কথাই সত্য হতে চলেছে।

এ পর্যন্ত আমেরিকা আক্রান্ত- ১২,৬৩,১৮৩, মৃত- ৭৪,৮০৭, আর সুস্থ হয়েছে- ২,১৩,০৮৪ জন। এই সতর্কতা না মানা, অবহেলা করার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। বিল গেটস অনেক আগে থেকেই বলে আসছে যে কোন মহামারী আসলে আমাদের প্রস্তুতি কী? আমাদের স্বাস্থ্যখাতে আরও গবেষণা প্রয়োজন, অর্থ আরও ব্যয় করা দরকার। কিন্তু কেউ তার কথা গুরুত্ব দেয়নি। এখন আলোচনা চলছে কী করে ভ্যাক্সিন বাজারে আনা যায়। চলছে ট্রায়াল।

গবেষকরা চেষ্টা করছে তাদের সাধ্যমত। তবে তারা এটাও বলছে, এই করোনাভাইরাস রেস থেকে যাবে প্রায় দুইবছর। ভ্যাক্সিন বাজারে না আসা পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। যেকোন মুহূর্তে জনসমাগম থেকে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। লকডাউনের ফলে এখন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে আসছে।

কিন্তু আমরা যাদের হারিয়েছি তারা তো আর ফিরে আসবে না। যারা বেঁচে আছি সাবধানতাই এখন আমাদের একমাত্র পথ। যদিও করোনা রোগীর ইমারজেন্সি ব্যবহারের জন্য Remdesivir ওষধের কথা বলেছে আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড, ড্রাগ প্রশাসন তা অনুমোদন করেছে। তবুও বলব, সতর্ক থাকাই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো পন্থা। যতটুকু সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলা, অপ্রয়োজনে ঘুরাঘুরি না করা, এটাই হল নিরাপদ থাকার উপায়, যতদিন ভ্যাক্সিন বাজারে না আসে।

সূত্র: যুগান্তর

 

আরপি/এমএএইচ

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top