রাজশাহী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন নীতিমালা : কিছু প্রশ্ন


প্রকাশিত:
৬ আগস্ট ২০১৯ ১৯:৫৮

আপডেট:
৬ আগস্ট ২০১৯ ২০:০১

মিলি সাহা

শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যেশ্যে গত ৪ অগাস্ট একটি সভা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি দু-তিনদিনের জন্য পিছিয়েছে। উক্ত সভায় উপস্থিত থাকবেন দুইজন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব, একজন উপসচিব, ইউজিসির চেয়ারম্যান ও তার সদস্যরা।

এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত সচিব এবং পরিচালক। যদিও কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি বা শিক্ষাবিদ উপস্থিত থাকছেন না, কমিটি বলছে এতে সকল উপাচার্যের মতামত নেয়া হয়েছে ও তাদের অনুমোদনও রয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চয়ই তারা আমার চেয়ে বেশি ভালো বুঝবেন, কিন্তু দলীয় হিসেবে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকারও ওনারাই আগে করবেন। তাই সাধারণ শিক্ষকদের আরেক দফা অন্ধকারে রেখেই হয়তো এই নীতিমালা পাস করিয়ে নেয়া হবে। তবুও একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, সাধারণের সচেতনতার জন্য।

শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা অভিন্ন করলেই শিক্ষার মান বাড়বে, তার কোনো ভিত্তি নেই। শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন খুবই জরুরি। অভিন্ন নীতিমালা দিয়ে রাতারাতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সমমান তো নিশ্চিত হবেই না, বরং বর্তমান বিধির সাথে সাংঘর্ষিক সব নিয়ম প্রবর্তন করে পেছনে হাঁটাই হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির নিয়ম অভিন্ন করা হোক এমনভাবে যেন সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আরো বেশি উৎসাহিত হন, আমরা যেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হতে পারি। অভিন্নতার দায় দিয়ে অযোগ্যতাকে উৎসাহিত করে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে চাই না 

প্রস্তাবিত অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালা হয়েছে অনেকটা বানরের পিঠা ভাগের মতো। কোথাও শুধুই অভিন্ন রাখতে শিক্ষকদের পদোন্নতির যোগ্যতার শর্ত ব্যাপক ভাবে শিথিল করে শিক্ষার মান অবনয়ন সম্পন্ন হয়েছে। আবার অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকদের অন্যদের আগে আগে অধ্যাপক হবার পথ রোধ করতে শুধুই শিক্ষকতার দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণাকে বিরল ভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। শিক্ষার মান অভিন্ন করতে তো শিক্ষকের মান কমিয়ে ফেলার কথা নয়। বরং পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আদলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নই কাম্য।

শুরুতেই আসি প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষায়; জানিনা পৃথিবীর কোথায় এই পদ্ধতি রয়েছে। এ পর্যন্ত যতদূর দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছি সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে সরে গিয়ে সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে প্রহসনের প্রশ্ন করে বিগত চারটি পরীক্ষায় ৪/৪ বা ৩.৫/৪ সিজিপিএ ধারীদের অযোগ্য প্রমাণ করে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে এমন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিষয়ে বিশেষ ও গভীর জ্ঞানের অধিকারীরাই শিক্ষকতা করার কথা, সারা বিশ্বের চলমান খবর ও রাজনৈতিক ইতিহাস জ্ঞান ঐসব বিষয়ের ছাত্রদের কি উপকারে আসবে জানি না। রয়েছে স্বজনপ্রীতি ও প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ। বাইরের দেশ গুলিতে ডেমোস্ট্রেশন ক্লাসের বাইরেও প্রার্থীদের থিসিসের বিষয়ের ওপর সেমিনার বা বক্তৃতা করতে হয়। প্রয়োজনে সেটিও যোগ করুন, তবুও বিশেষজ্ঞরাই শিক্ষক হোক, অনুগতরা নয়!

যেখানে ঢাকা, নোয়াখালীসহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হবার জন্য তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রকাশনার শর্ত রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে নুতন করে দুটি প্রকাশনার শর্ত দিয়ে কি করে অনিয়মের পদোন্নতি রোধ করা যাবে তা আমার জানা নেই, শিক্ষা বা শিক্ষকতার মান তো দূরের ব্যাপার।

যখন বিশ্বব্যাপী পিএইচডি ডিগ্রি হলো প্রভাষক নিয়োগের ন্যূনতম শর্ত; জগন্নাথের মতো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের পরে আরেকটি উচ্চতর ডিগ্রি ব্যতীত সহযোগী অধ্যাপক হওয়া যায় না, তখন প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী সেটি শিথিল করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কি উপকার হবে? বিশ্ববিদ্যালয় যদি শুধুই বই ধরে পড়ায় আর পরীক্ষা নেয় তাহলে বিশ্বের সাথে যোগ হবে কেমন করে? গবেষণার দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখে দিলে আধুনিকতাটুকু তবে কোথা দিয়ে আসে?

অতি সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের সভায় পাস হয়ে গেলো পিএইচডি ব্যতিরেকে অধ্যাপক না হবার নিয়ম। দেশজুড়ে শিক্ষক সমাজ বাহবা দিলো; হয়তো এবার বাকিরাও এটি অনুসরণ করবে এবং শিক্ষকদের মধ্যে উচ্চতর গবেষণার হার প্রতিযোগিতামূলক ভাবে বাড়বে, এই আশায়। প্রস্তাবিত নতুন নিয়মে পিএইচডি ছাড়াও অধ্যাপক হবার সুযোগ পিছিয়েছে মাত্র দু'বছরের জন্য। কতটা স্থুলভাবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাপ্রেমী শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা হলো!

একজন শিক্ষক সাত থেকে নয় বছরের অভিজ্ঞতায় প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হলেও শুধু অধ্যাপক হবার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে আরো প্রায় সমপরিমাণ আট বছর সময়! এটি কি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের 'বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো বেশি সংখ্যক অধ্যাপক' কমানোর প্রচেষ্টা নয়? এই চেষ্টা করতে গিয়ে পুরো প্রস্তাবনায় কত অপচেষ্টাই না হলো! বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পিএইচডি বিহীন প্রফেসর রেখে প্রশাসন ও পরিচালনায় কারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান?

ফেডারেশন বা ফোরামের শিক্ষক নেতারা কি সংশোধনী প্রস্তাব করেছেন, তা এখনো সাধারণ শিক্ষকরা জানেন না। বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ক্রমবর্ধমান আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের এই পরিস্থিতি তৈরিতে আমাদের সবারই দায় রয়েছে। রাজনীতির বিভাজন, ৭৩' এর অধ্যাদেশের অপব্যবহার, ঢালাও ভাবে অনিয়ম ও নির্দলীয় শিক্ষক নেতৃত্বের অভাব সরকারের এই অনড় অবস্থানের জন্য অনেকাংশে দায়ী। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা, মুক্ত-বুদ্ধি চর্চা ও গবেষণার চারণ ভূমি, কর্তৃত্ব ও নিয়মের বেড়াজালে এটিকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে হিতে বিপরীতই হবার কথা।

তাছাড়া, শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা অভিন্ন করলেই শিক্ষার মান বাড়বে, তার কোনো ভিত্তি নেই। শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন খুবই জরুরি। অভিন্ন নীতিমালা দিয়ে রাতারাতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সমমান তো নিশ্চিত হবেই না, বরং বর্তমান বিধির সাথে সাংঘর্ষিক সব নিয়ম প্রবর্তন করে পেছনে হাঁটাই হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির নিয়ম অভিন্ন করা হোক এমনভাবে যেন সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আরো বেশি উৎসাহিত হন, আমরা যেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হতে পারি। অভিন্নতার দায় দিয়ে অযোগ্যতাকে উৎসাহিত করে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে চাই না।

 

লেখক : মিলি সাহা, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top