রাজশাহী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


এমন ভয়াবহ নির্যাতন হয়! জানা ছিল না


প্রকাশিত:
৩ মে ২০২০ ০১:৩৭

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ১২:৪৩

সামেরা আল-হুরি

ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ইয়েমেনের নারীরা। গণগ্রেফতার, হত্যা, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের দৈহিক ও মানষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা।দেশটির রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চল হুতি বিদ্রোহীদের দখলে।

সেখানেই চলছে এসব নির্যাতন। মানবধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা জানান, দীর্ঘ পাঁচবছরের এ যুদ্ধে ক্রমেই নৃশংসতা বেড়েছে নারীদের ওপর। এর মধ্যে মেয়েরাই বেশি ঝুঁকিতে। ইয়েমেনের মানবাধিকার কর্মী এবং পিচ ট্র্যাক ইনেশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা রাশা জারহুম বলেন, ‘ইয়েমেনের নারীদের জীবনে ঘটতে থাকা অত্যন্ত কুৎসিত ও অন্ধকার দিক এটি।

যুদ্ধ শুরুর আগে নারীদের রক্ষায় দেশটিতে কোন আইন বা প্রতিষ্ঠান ছিল না। নৈতিক ও গোত্রীয় কিছু নীতির মাধ্যমে নারীরা সুরক্ষা পেত।। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা যতো বেড়েছে সে সব নিয়ম নীতি ভেঙ্গে পড়েছে।’
বছরের শুরুতে জাতিসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ দল তদন্তে খুঁজে পায়, যে সব নারী হুতি বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করছে তারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে হুতিরা সানায় অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান হিসেবে সুলতান জাবিন নামে এক লোককে নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই গণগ্রেফতার ও নির্যাতনের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। নারী নির্যাতন এখন যুদ্ধপারাধের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।

হুতিরা নারী যোদ্ধাদের নিয়ে ‘জায়নাবিয়াত’ নামে একটি দল গঠন করেছে। তাদের কাজ হচ্ছে যে সব নারী হুতিদের বিরোধিতা করবে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়া। রাশা জারহুম বলেন, ‘ইয়েমেনের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি আমরা এই প্রথম দেখছি।’

সামেরা আল-হুরির অভিজ্ঞতা ছিল এমন-রাজধানী সানায় একদিন কয়েকজন হুতি কর্মকর্তা হঠাৎ করেই আল-হুরিদের বাড়িতে হানা দেয় এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা সামেরাকে একটি স্কুলের বেজমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে আরও কয়েকজন নারীকে আগে থেকেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হতো, দেয়া হতো ইলেক্ট্রিক শক। চলতো আরো নানা শারীরিক নির্যাতন। তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়।

৩৩ বছর বয়সী সামেরা আল-হুরিকে তিন মাস হুতি বিদ্রোহীরা বন্দি করে রাখে। পরে ক্যামেরার সামনে তাকে পতিতাবৃত্তিতে জড়িত থাকার স্বিকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। ইয়েমেনে পতিতাবৃত্তি আইনের চোখে অপরাধ।

সংবাদ সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সামেরা আল-হুরি নিজের ওই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। জানান, রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তাইজ স্ট্রিটে বিভিন্ন বাড়ি ও স্কুলে নারীদের বন্দি করে রাখার গোপন সেলগুলোর কথা। যেখানে কয়েকশ নারী আছে।

তিনি বলেন, ‘নানা শারীরিক নির্যাতনের পাশপাশি নারীদের ধর্ষণও করা হয়। সেখানে অনেকের অভিজ্ঞতা আমার চেয়েও খারাপ। বন্দি নারীদের মধ্যে স্কুলের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি কিশোরীরাও ছিল। হুতি বাহিনী আমার মাথা এমনভাবে টেবিলে ঠুকে দিতো যে, মুক্তির পর আমার চোখে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে।’

২০১৯ সালের জুলাই মাসে কালাশনিকভ হাতে একদল মুখোশ পরা কর্মকর্তা সামেরাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘তাদের আয়োজন দেখে মনে হচ্ছিল আমি ওসামা বিন লাদেন। আমার অপরাধ, আমি তাদেরকে আমার সহযোদ্ধা মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে তথ্য দেওয়ার এবং গোয়েন্দাগিরি করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।’

সানার অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান সুলতান জাবিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন জানিয়ে সামেরা আল-হুরি আরও বলেন, ‘জাবিন দেখতে সুন্দর মেয়েদের স্কুলের বাইরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতেন। সেখানে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো।জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলটিও জাবিনের গোপন একটি বন্দিশালা থেকে দৌড়ে বের হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন৷ সেখানে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো।

উইমেন ফর পিস ইন ইয়েমেন কোয়ালিশন- এর প্রধান নূরা আল-জারউই বলেন, রাজধানীর দক্ষিণে ধামার প্রদেশে আরেও শতাধিক নারীকে বন্দি করা হয়েছে। হুতি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়া নারীদের জন্য মিশরের কায়রোতে একটি আন্তর্জাতিক সাপোর্ট গ্রুপ পরিচালনা করেন আল-জারউই৷ তিনি ৩৩ জন নারীর কথা জানান, যারা হুতি বন্দিশালায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে আটজন প্রচণ্ড নির্যাতনে প্রায় মরতে বসেছিলেন।

পাঁচ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে ইয়েমেনের অনেক পুরুষ হয় মারা গেছেন বা জেলে রয়েছেন৷ ফলে রক্ষণশীলতা ভেঙে নারীরা এখন রাজনীতিতে আসতে শুরু করেছেন। তবে হুতি সরকারের মানবাধিকারমন্ত্রী রাদিয়া আব্দুল্লাহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, ‘যদি এসব অভিযোগ সত্য হয় তবে আমরা এ সমস্যার সমাধান করবো।’ হুতি মন্ত্রিসভার দুই নারী মন্ত্রীর একজন তিনি। তিনি বলেন, ‘পতিতাবৃত্তি দমন অভিযানে কয়েকটি ক্যাফে, অ্যাপার্টমেন্ট এবং নারীদের সমাবেশ থেকে কয়েকজন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বলেন, ‘‌‌তারা সমাজকে অপরাধগ্রস্ত করেছে এবং শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করছে।’

২০১৭ সালের শেষ দিকে হুতিরা তাদের এক সময়ের মিত্র সাবেক শাসক আলি আব্দুল্লাহ সালেহকে হত্যা করে। সালেহর মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ওই সময় নারীরা কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল। তারপর থেকেই মূলত নারীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দমন অভিযান শুরু হয়।

 

 

আরপি/ এমবি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top