ওড়িশা উপকূলে তাণ্ডব চালাচ্ছে ইয়াস

ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে ভারতের ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে তাণ্ডব শুরু করেছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ওড়িশা উপকূলে চলছে প্রবল বৃষ্টি আর দমকা বাতাস। সাগর ফুলে ওঠায় প্লাবিত হয়েছে উপকূলের নিচু এলাকা। জান-মাল রক্ষায় নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
ভারতের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ ঝড়ের উপকূল অতিক্রম করার পর্যায় শুরু হয় বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে। তখন ইয়াসের অবস্থান ছিল ওড়িশার বালাশোরের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে।
বালাশোর ও ধামারার মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রভাগ বা চোখ পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগতে পারে বলে ভারতের আবহাওয়াবিদদের ধারণা।
সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে; পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
অতি প্রবল এ ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৪ কিলোমিটারের মধ্যে তখন বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
ইয়াস বাংলাদেশের উপকূল থেকে দূরে থাকলেও সাগর উত্তাল থাকায় সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুর্ঘটনা এড়াতে নদীপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
এর মানে হল, বন্দর ও বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলো দুর্যোগ কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে উত্তর বঙ্গোসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
উপকূলের মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরতে মাইকিং হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে। ছবি: রয়টার্সউপকূলের মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরতে মাইকিং হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে। ছবি: রয়টার্সএনডিটিভি জানিয়েছে, ওড়িশা উপকূলের নিচু এলাকাগুলো থেকে আড়াই লাখ এবং পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ উপকূল থেকে সাড়ে ১১ লাখ মানুষকে ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের দীঘা সৈকত থেকে আসা ছবিতে দেখা গেছে, প্রবল বাতাসে নুয়ে পড়ছে গাছ। উপকূলীয় অনেক এলাকায় জোয়ারের পানি উঠে রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। হাঁটু পানির মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে মানুষ।
ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে, ওড়িশার জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক ও বালাশোর জেলা ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা লাগতে পারে সবচেয়ে বেশি।
আর পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদেনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে ঝড়ো বাতাসের তাণ্ডব।
আনন্দবাজার লিখেছে, বুধবার পূর্ণিমা এবং চন্দ্রগ্রহণ থাকায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে জোয়ারে। ভরা কাটালে ঝড় উপকূল অতিক্রম করায় পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় টর্নেডোর আঘাতে প্রাণ গেছে দুইজনের, শ খানেক ঘরবাড়িও বিধ্বস্ত হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এই নতুন দুর্যোগে সংক্রমণ এড়ানো আর রোগী সামলানোর কথাও ভাবতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। ওড়িশার বিশেষ রিলিফ কমিশনার পি কে জেনা জানিয়েছেন, ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেন এবং বিদ্যুতের সঙ্কট যেন না হয়, সে ব্যবস্থা তারা করছেন।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক মঙ্গলবার রাতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় তার অফিস নবান্নে বসে পর্যবেক্ষণ করছেন পুরো পরিস্থিতি।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ভুবনেশ্বরের বিজু পট্টনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওড়িশার বীর সুরেন্দ্র সাই বিমানবন্দর, দুর্গাপুর বিমানবন্দর বন্ধ রাখা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বুধবার সকাল থেকে কলকাতার নয়টি ফ্লাইওভারেও যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছে বলে খবর দিয়েছে আনন্দবাজার।
ভারতীয় রেলওয়ে ৩৮টি দূরপাল্লার ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে ইতোমধ্যে। আগামী শনিবার পর্যন্ত এসব ট্রেন চলবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য উপকূলে প্রস্তত রাখা হয়েছে ভারতের নৌবাহিনীর সদস্যদেরও। বিশাখাপত্তমে নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদরদপ্তর থেকে পুরো কার্যক্রমের সমন্বয় করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজের জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এনডিটিভি জানিয়েছে, ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের রেকর্ড ১১৫টি দলকে এবারের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় মাঠে নামানো হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণের সঙ্গে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলীয় জেলার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার জোয়ার প্লাবিত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়টির গতিমুখ বাংলাদেশের দিকে না হলেও এর প্রভাব বলয়ে খুলনা উপকূল থাকছে বলে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, প্রায় ১৫ হাজার আশ্রয় কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আরপি/এসআর-০৫
বিষয়: ওড়িশা উপকূল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: