রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


হিমাগার রাখা আলুর অর্ধেক দামও পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা


প্রকাশিত:
৫ অক্টোবর ২০২১ ২০:১৬

আপডেট:
৫ অক্টোবর ২০২১ ২০:১৬

ছবি: হিমাগার

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলুর দরপতনে কৃষকসহ ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। গেল বছরে লাভ বেশি পাওয়ায় এ বছর কৃষকেরা বেশি জমিতে আলু আবাদ করেন। ফলনও পান বাম্পার। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও হোটেলসহ খাবারের দোকানগুলো বন্ধ থাকায় বাজারে আলুর বিক্রি কমে যায়। ফলে চাহিদা না থাকায় হিমাগারগুলোতে সংরক্ষিত বিপুল পরিমান আলু অবিক্রীতই রয়ে গেছে। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের একমাত্র হিমাগার এগ্রো মহানন্দা কোল্ড স্টোরেজে প্রায় ৩০০ জন কৃষক ও ব্যবসায়ীর ৫০০ মেট্রিক টন আলু মজুদ রাখা হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে লাভের আশায় আলু মজুত করে এখন বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা। গত বছর করোনা ও বন্যায় অসহায় মানুষদের পাশে সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি অনেক মানুষ এগিয়ে আসায় ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে আলুই ছিল অন্যতম সামগ্রী। ফলে সে বছর আলুতে প্রচুর লাভের মুখ দেখেন আলু ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরে বেশি দামের আশায় অনেকে আলু হিমাগারে মজুদ করেন। কিন্তু বাজারে ভালো দাম না থাকায় এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের।

এ বছর হিমাগার খরচসহ প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৮-২০ টাকা। আর বর্তমানে আলু বিক্রি হচ্ছে পতি কেজি ১০ থেকে সাড়ে ১০ টাকায়। এতে প্রতি কেজিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে সাড়ে ৭ টাকা থেকে ১০ টাকা। তাই হিমাগারগুলোতে পাইকারি ব্যবসায়ী না যাওয়ায় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে হিমাগারগুলোতে আলু পচে নষ্টও হচ্ছে ব্যাপক হারে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, ভালো দাম পাওয়ার আশায় হিমাগার থেকে ঋণ নিয়ে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন তারা। কিন্তু আলুর দাম কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।

সদর উপজেলার আঙ্গারিয়াপাড়া মহল্লার আলু চাষী শামিম আহমেদ জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করেন তিনি। এখন প্রতি কেজি আলু ১০ থেকে ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে এ বছর প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো লোকসান গুনতে হবে তার। লোকসান ঠেকাতে এবং কৃষক বাঁচাতে সরকারকে আলু বিদেশে রপ্তানি করার দাবি জানান তিনি।

ব্যবসায়ী মহব্বত আলী বলেন, চলতি বছর হিমাগার খরচসহ বস্তা প্রতি খরচ হয়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। বিক্রি করতে গিয়ে বস্তা প্রতি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা করে দাম পাচ্ছি। কেজি প্রতি যা ১০ থেকে ১১ টাকা করে। ২০ লাখ টাকার আলুতে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা পাচ্ছি। আলু নিয়ে পথে বসে গেছি।

প্রায় ১৭ বছর ধরে আলুর ব্যবসা করেন খাইরুল ইসলাম। তিনি জানান, ১৯ লাখ ৬০০ টাকার আলু কিনে বিক্রি করে পেয়েছেন ৮ লাখ ৫০০ টাকা। গত বছর আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশাসন থেকে বারবার দাম কমানোর জন্য এসেছে। দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ বছর তো আমরা দাম পাচ্ছি না। এ বছর কেউ আসে না। কৃষক মরলেও কেউ দেখে না।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুমন আলী বলেন, গত বছরের লাভের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ বছর কোল্ড স্টোরেজে ৩০০ বস্তা আলু রেখেছিলাম৷ আলু বিক্রি করে কেনা দামটাও পাচ্ছি না। কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া পরিশোধ করতে না পেরে নিজের নসিমন (ভুটভুটি) পর্যন্ত বিক্রি করেছি। সব মিলিয়ে কেজি প্রতি ১৯ টাকা খরচ হয়েছিল। বিক্রি করে ১০ থেকে ১১ টাকা পাচ্ছি।

জেলার একমাত্র হিমাগারে ভুটভুটি চালান রহমত আলী। তিনি জানান, প্রথমবারের মতো এ বছর ৩০০ বস্তা আলু রেখেছি। নিজের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ভুটভুটি বিক্রি করেও হিমাগারের ভাড়া শোধ হয়নি। পরে বাড়িতে পোষা একটি গরুও এনে হিমাগারে জমা দিয়েছি। এছাড়া এনজিও লোনের টাকা তো পড়েই আছে এখনও।

মহানন্দা কোল্ড স্টোরেজের শ্রমিক শাহালাল বলেন, আলুর দাম নেই। তাই ব্যবসায়ীরা স্টোরেজ থেকে আলু বের করছে না। আর আলু বের না করলে আমাদের কাজও বন্ধ। একবেলা কাজ হলে আরেক বেলা বন্ধ। কয়েকমাস থেকে এভাবে চলছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এখানকার শতাধিক শ্রমিকের সর্দার মো. সাকিম বলেন, আলু বের না হওয়ার কারণে শ্রমিকদের নিয়ে বসে বসে আমাদের দিন কাটছে। দাম না পেয়ে মালিক যেমন পথে বসেছে, তেমনি কাজ না পেয়ে আমাদের অবস্থাও একই। অন্যান্য বছর এই সময়ে হিমাগার থেকে দৈনিক ৮০০ থেকে ১০০০ বস্তা আলু বের করা হয়। কিন্তু এখন দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ বস্তা করে আলু বের হচ্ছে।

এসব বিষয়ে নিয়ে এগ্রো মহানন্দা কোল্ড স্টোরেজের সহকারী ব্যবস্থাপক গোলাম জাকারিয়া জানান, চলতি বছরে জেলার একমাত্র হিমাগারে ৫৫০০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করেছি। দাম না পেয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছে না৷ প্রতিকেজি আলুতে হিমাগার খরচসহ সাড়ে ১৯ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে আলুর দাম ১০ থেকে ১১ টাকা কেজি। এ কারণে কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার কর্তৃপক্ষ সকলেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত।

তিনি আরও জানান, হিমাগারের মাধ্যমে জেলায় তিন শতাধিক আলু চাষীকে বীজ সরবরাহ করা হয়। তারাও এখন আলু রেখে হিমাগার বিমুখ হয়ে গেছেন। সরকার এ ব্যাপারে দৃষ্টি না দিলে হিমাগার, কৃষক ও ব্যবসায়ী সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর আলু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা অস্বাভাবিক হারে লাভ করেছেন। ফলে চলতি বছরে জেলায় আলু চাষের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া অন্যবারের মতো এবার বৃষ্টি ও বন্যায় বিভিন্ন শাকসব্জিও নষ্ট হয়নি। এর ফলে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও শাকসবজির বাম্পার ফলনে আলুর দাম কমেছে।

উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর ১৩০০ হেক্টর জমিতে ২২৬১০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৪০ হেক্টর জমিতে ৬১৬৫ মেট্রিক টন, শিবগঞ্জে ৪১০ হেক্টর জমিতে ৬৩২০ মেট্রিক টন, গোমস্তাপুরে ২৭৫ হেক্টর জমিতে ৪৭৫০ মেট্রিক টন, নাচোলে ৩৫ হেক্টর জমিতে ৬৭৫ মেট্রিক টন ও ভোলাহাট উপজেলায় ২৪০ হেক্টর জমিতে ৪৭০০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়।

বর্তমানে দেশ থেকে ২০ ভাগ আলু বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তর এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে সমন্বয় করে আলু রপ্তানি বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ও হিমাগার ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা, আলুর বিভিন্নমুখী ব্যবহার ও বিদেশে রপ্তানি করাসহ খুব দ্রুত দরকার সরকারি উদ্যোগ। এতে কৃষকের হতাশা কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করেন তারা। 

 

 

আরপি/এসআর-১২



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top