বাগানের পাশেই গরুর খামার আর শত শত বাহারী কবুতর।ছয় বিঘার খামারের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৫ বিঘায়। সারা বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার ব্যবসা। সফল কৃষি উদ্যোক্তা আতিক এখন অন্যদের উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করছেন। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন ২০১৪ সালে দেশের সেরা ফল চাষি হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার মাধ্যমে। জাতীয় পর্যায়ে ২০১৪ সালে ফলদ বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় কৃতিত্বেরস্বীকৃতি স্বরূপ ব্যক্তি পর্যায়ে নাটোরের আতিক দেশ সেরা।নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার সেনভাগ গ্রামের কৃষক আবুল হোসেনের ছেলে আতিকুর রহমান আতিক।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর ডেন্টাল কোর্স শেষ করে বেকার জীবনে দেখা দেয় হতাশা। এ সময় টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কৃষি বিষয়ক প্রতিবেদন দেখে পরামর্শ নেন কৃষি বিভাগের। বাড়ির সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে ছয় বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ২০০৯ সালে গড়ে তোলেন পেয়ারা বাগান।এরপর থেকে এই কৃষি উদ্যোক্তার শুধুই সামনে এগিয়ে চলা।
সাফল্যের এই গতি ধারায় আতিক তার ফলের বাগানকে সম্প্রসারিত করেছেন একশ ২৫০ বিঘায়। শত শত যুবক ও আগ্রহীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করছেন।আতিক শুরু করেছিলেন থাই-৩ জাতের পেয়ারা দিয়ে। স্থান ভেদে একর প্রতি এর গড় ফলন প্রায় দুই টন। খরচ বাদে মুনাফা অন্তত ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। চারা লাগানোর ১৮ থেকে ২৪ মাস পর থেকে সারা বছর ফলন পাওয়া গেলেও বর্ষা মৌসুমে অধিক ফলন হয়। আতিকের বাগানের পেয়ারা প্রতিদিন ঢাকায় যাচ্ছে। পরিমাণে ৪০ থেকে ২০০ মণ পর্যন্ত।ঢাকার কারওয়ান বাজারের কিরন ট্রেডার্স ও রুপসী ভান্ডারের মতো বৃহৎ আড়তদার আতিকের খামারের পেয়ারার নিয়মিত পাইকারী ক্রেতা।
কিরন ট্রেডার্সের মালিক কিরন খান বলেন, সুমিষ্ট ও সুস্বাদু হওয়ায় প্রান্তিক ক্রেতা পর্যায়ে এই পেয়ারার চাহিদা ব্যাপক।আতিক দাবি করেছেন, তার খামারে উৎপাদিত পেয়ারা ও অনান্য ফল কীটনাশক ও সব রকমের রাসায়নিক মুক্ত। তিনি বলেন, গাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য মাটিতে জৈব সার এবং পোকামাকড় দমনে ব্যবহার করি সেক্্র ফেরোমেন হরমোন প্রযুক্তি। ক্ষতিকারক মাছির সংক্রমন থেকে রক্ষা পেতে গাছের পেয়ারাগুলোকে পিপি পলিথিনে মুড়ে দেয়া হয়। সারা দেশে ফলের রাসায়নিক দূষণের আতংক সংবাদে আতিকের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং ক্রেতা পর্যায়ে প্রশান্তির।নাটোর শহরতলীর দিঘাপতিয়ায় স্থাপিত নতুন খামারে নতুন জাতের টেপ কলমের পেয়ারা লাগিয়েছেন আতিক। মাত্র এক বছরের মাথায় এর ফলন পাওয়া যায়। এই বাগানেই লাগিয়েছেন ২৪০টি ড্রাগন গাছ। আছে স্ট্রবেরী। ১২বিঘার প্লটে খেরসা, আম্রপালী ছাড়াও লাগিয়েছেন নতুন প্রজাতির বারি-৪ জাতের আম গাছ- যার ফলন বর্ষা শেষে। ১০ বিঘার প্লটে আছে কলম্ব, সুগন্ধি ইত্যাদি জাতের লেবুর গাছ। খামার সংরক্ষণে চারিদিক দিয়ে লাগিয়েছেন এলাচি ও কাগজী লেবুর তিন হাজার গাছ।
প্রাণ শক্তিতে ভরপুর আতিক বলেন, ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে আমি খামারে যাই। তত্ত্বাবধান করি খামারে নিয়োজিত২০০ জন মানুষের কর্মযজ্ঞ। আতিকের বাগানে ৬০ জন নারী শ্রমিকসহ মোট ২০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যেকের মাসিক পারিশ্রমিক ১০ হাজার ৫০০টাকা। ফল ওঠার মৌসুমে ব্যস্ত সময়ে আরো যোগ হয় মৌসুমী কর্মজীবী- যাদের বেশির ভাগ স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। আতিক আরো বলেন, খামারে আমার কাজে নিয়মিত সহযোগিতা দিয়ে থাকে কৃষিতে অনার্স পড়–য়া ছোট বোন আরিফা।আতিক শুধু ফল নয়, ফলের চারা তৈরি ও বিপণন করেন। সফল উদ্যোক্তা হয়ে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছেন।
নাটোর শহরতলীর বড় হরিশপুর এলাকায় মনির হাসান আতিকের কাছ থেকে সাহস ও শক্তি নিয়ে গড়ে তুলেছেন সাড়ে সাত বিঘার পেয়ারা বাগান। সূদুর ঝালকাঠি জেলার নবগ্রামে হানিফ খান আতিকের কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে আট বিঘার পেয়ারা বাগান করেছেন তার এলাকায়। এই তালিকায় আরো রয়েছেন, ঝালকাঠি সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক কামাল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ছারখানায় ১০ বিঘার পেয়ারা বাগান।বৈচিত্রে অনন্য আতিক বাড়ির পাশে গড়েছেন গরুর খামার। আর দুইশ’ জোড়ার বাহারী সৌখিন কবুতর। আতিকের বাড়িতে রান্না হয় বায়োগ্যাসে। কাঁচামাল গরু আর কবুতর খামারের গোবর আর বিষ্ঠা। এর ব্যবহার জৈব সার হিসেবেও। আতিক বলেন, কবুতর খামারেই আমার বিনিয়োগ৪০লাখ টাকা। কৃষি খামার থেকে বছরে আতিকের আয় আসে প্রায়৪ কোটি টাকা।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. সাইফুল আলম বলেন, আতিক শুধু নিজেকেই সমৃদ্ধ করেননি, সমৃদ্ধ করেছেন নাটোরকে। সারাদেশের মানুষের জন্য তিনি একটি দৃষ্টান্ত। নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. আলহাজ উদ্দিন আহম্মেদ বাসসকে বলেন, আতিকের মতো সমৃদ্ধ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি হলে দেশ এগিয়ে যাবে অনেক দূর।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: