রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


কিছু শিশু দেরিতে কথা বলে কেন


প্রকাশিত:
২৩ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৫৪

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৪

ছবি: সংগৃহীত

ডা. সেলিনা সুলতানা

‘অটিজম’ ও ‘দেরিতে কথা বলা’- দুটোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনোটিই অবহেলা করা ঠিক নয়। শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত নয়, তার বিকাশে বিলম্ব হচ্ছে। একটু মনোযোগ দিয়ে তার অভিভাবকের কথা শুনলেই অনেকখানি ধারণা পাওয়া সম্ভব। অবশ্যই এর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। আমরা যদি শিশুর কেস হিস্ট্রিতে জন্মগত ও পারিবারিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করি, তাহলে একটি ব্যাপার খুবই সাধারণ বিষয় পাওয়া যায়। তা হচ্ছে- শিশুটির বাবা দেরিতে কথা বলছে বা শিশুটির দাদা দেরিতে কথা বলেছিল। তাই শিশুটিও দেরিতে কথা বলে। এসব বিভ্রান্তি যত দ্রুত দূর করা সম্ভব, যত তাড়াতাড়ি এ ব্যাপারে পরিষ্কার একটি ধারণা পাওয়া যাবে; ততই শিশুটিকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলার পথ সহজ হবে।


দেরিতে কথা বলা বিষয়ে প্রথমে দৃষ্টিপাত করতে হয় শিশুটির বয়স অনুযায়ী ধারাবাহিক বিকাশ হচ্ছে কি না তার দিকে। একটি শিশু যখন বড় হতে থাকে; তখন একটি নির্দিষ্ট বয়সে শেখা কিছু নির্দিষ্ট কাজই সে করবে, এটাই ধারণা করা হয়। যেমন তিন মাসের মধ্যে শিশুটির সামাজিক হাসি চলে আসবে, ঘাড় শক্ত হয়ে যাবে।

যখন আমরা দেখব শিশুটির মধ্যে এসব বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে না; তখনই বলবো শিশুটির ভেতরে কিছু বিলম্বের ব্যাপার আছে। এক বছরের একটি শিশুও বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে সামাজিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। যোগাযোগ স্থাপন যে শুধু কথা বলার মাধ্যমে হচ্ছে, তা নয়। আকার-ইঙ্গিত, শব্দ, শরীরের অঙ্গ-ভঙ্গি প্রভৃতি দিয়ে সে তার চাহিদাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করে। যেমন ধরা যাক, সাত-আট মাসের একটি শিশু শুয়ে থাকলে সে তার চারপাশের পরিবেশ চোখ ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, তার সামনে কেউ দাঁড়ালে সে বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। অনেক সময় দুহাত বাড়িয়ে দেয় তাকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য। এটাও একটি যোগাযোগ। যেটা কথার মাধ্যমে হচ্ছে না। কিন্তু কিছু শব্দের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা হচ্ছে, শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গি দিয়ে সে তার বয়স অনুযায়ী চেষ্টা করছে। এ জিনিসগুলো যদি ঠিকমত বিকাশ না করে, তাহলে আমাদের চিন্তার ব্যাপার আছে।

তারপর আমরা ১৮ মাস বা দেড় বছরে একটি শিশুর কথা চিন্তা করি। সেখানে দেখা যায়, এ বয়সের একটি শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ২০টি শব্দের ভান্ডার থাকে। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ‘হ্যাঁ, কথা বলছে’। মা, বাবা, দাদা, নানা, মামা- এগুলো তারা ওই ২০টি শব্দের মধ্যে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনো বিশেষ্য যেমন- ব্যক্তি বা বস্তুর নাম, স্থান, পাহাড়, নদী, বই, চাল, ডাল, পাখি, গাছ, মায়া, মমতা এগুলো নেই। কোন বিশেষণ থাকে না, যেমন লাল-সবুজ পতাকা, সুন্দর দেশ, ভালো মানুষ, নতুন বই। আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, তোমাদের, আমাদের, নিজেকে বা অপরকে, কি, কিভাবে, কারা, কার, কেউ, কিছু- এগুলোতে পার্থক্য বোঝা সম্ভব হচ্ছে না।

পাখিরা আকাশে ওড়ে, ফুল ফুটেছে, সে স্কুলে যাবে, আমি বই পড়বো, পাখি গান গায়, পাখি ডাকে, আমি ভাত খাবো, আমাকে ভাত দাও- এ ধরনের বাক্য বলতে তাদের অনেকটাই সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় সে তার শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গি দ্বারা তার গরম লাগছে, শীত লাগছে, খাবারে ঝাল বেশি হয়েছে- এগুলো বোঝানোর চেষ্টা করে, এগুলো বিশেষণ। কিছু ক্ষেত্রে কোলে নাও, আমাকে উপরে তোল, নিচে নামাও- এ ধরনের পদান্বয়ী অব্যয় থাকার কথা, এগুলো একটি শব্দ যা একটি বাক্যের মধ্যে বিশেষ্যসমূহ, সর্বনামসমূহ বা শব্দাংশসমূহের সাথে অন্য শব্দসমূহ যুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি শিশুর কথার ভেতরে এগুলো থাকে। এগুলো অনুপস্থিত থাকলেও বোঝা যায় শিশুটির বিকাশ বিলম্বিত হচ্ছে।


২৪ মাস বা দুই বছরের একটি শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০টি শব্দের ভান্ডার থাকবে। সে দুটো শব্দ একত্রে করার চেষ্টা করবে। এখানে আসো, ভাত খাও ইত্যাদি। এছাড়া সে কিছু সাধারণ নির্দেশনাও ফলো করবে, যেমন- বসো, যাও, খাও, ইত্যাদি।

৩৬ মাস বা তিন বছরের একটি শিশুর কথার মধ্যে বেশ লম্বা একটা বাক্য থাকবে এবং সেগুলো একটু বড়ই থাকবে। সে বড় বাক্য ব্যবহার করবে। দুটো-তিনটে ইনস্ট্রাকশন একবারে ফলো করার চেষ্টা তার মধ্যে থাকতে হবে। যেমন- ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাও, গ্লাস এনে পানি খাও। অনেক সময় বাবা-মা বলেন, ওতো কথা বলছে- চলো, যাও, খাও, বসো, আসো- এগুলো ফলো করবে। কিন্তু এগুলো একটি ছোট বাক্য বা শব্দ, দেখা যায় দুটো বাক্য একসাথে করে কথা বলার চেষ্টা তারমধ্যে নেই। সে ক্ষেত্রেও আমাদের একটু চিন্তা করতে হবে, তারমধ্যে দেরিতে কথা বলার একটি প্রবণতা আছে কি না। তিন বছরের ভেতর তারমধ্যে কেন, কোথায়, কে- এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা থাকতে হবে, যেমন- কোথায় যাচ্ছো? কেন যাচ্ছো? কিভাবে যাচ্ছ?

যখন আমরা দেখব শিশুটি এ ধরনের ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন বা শিশু বিকাশজনিত মাইলস্টোন অনুসরণ করছে না, তখনই আমরা বলব শিশুটির ভেতর একটু দেরিতে কথা বলার বা দেরিতে বেড়ে ওঠার প্রবণতা আছে।

কিন্তু যদি শিশুটি অটিজম স্পেকট্রামে থাকে; তখন এ দেরিতে কথা বলার সাথে সাথে শিশুটির ভেতরে আরও কিছু ক্লিনিক্যাল ফিচার বা অন্যান্য উপসর্গ বা লক্ষণগুলোও চলে আসবে। সামাজিক হাসি অনুপস্থিত থাকবে, আমরা যখন কোনো ছোট শিশুকে দেখে হাসি, শিশুটিও সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তার হাসির ভেতর। কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ভেতর এটি অনেকটা কম থাকবে বা একেবারে থাকবেই না।

শিশুটির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার চেষ্টা খুবই কম থাকবে। যখন আমরা কারো সাথে কথা বলি, একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করি। সে যা বলে তা বোঝার চেষ্টা করি- এতে তার মনোযোগ আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুটি অস্থির থাকে, সে চোখের দিকে না তাকিয়ে তার চারপাশের পরিবেশের দিকে বা নির্দিষ্ট কোনো কিছুর দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আবার চোখের দিকে তাকায় অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে। চোখের দিকে তাকানো- যোগাযোগের একটি বিশাল মাধ্যম, অটিস্টিক শিশুর বেলায় যা অনুপস্থিত বা কম থাকে।

যখন আমরা শিশুটিকে নাম ধরে ডাকি, তার মধ্যে ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রবণতা কম দেখা যায়। আর এজন্য অনেক সময় বাবা-মার মনে হয় তার শিশুটি শুনতে পায় না। কিন্তু তার আশেপাশে যদি তার পছন্দ অনুযায়ী কোন জিনিসের প্যাকেট খোলা হয়। যেমন- চিপস, চকোলেট বা তার প্রিয় খেলনার নড়াচড়া- খুব অল্প সাউন্ড হলেও সে ঘুরে তাকায়, এতে প্রমাণ হয় শিশুটির শুনতে কোন সমস্যা নেই। শুধু সে সাড়া দেয় না বা রেসপন্স করে না।

শিশুদের ভেতরে সাধারণত প্রিটেন্ড বা অভিনয় করে খেলার ইচ্ছা থাকে ছোটবেলা থেকেই। যেমন সে একটি স্টিক নিয়ে কানে লাগিয়ে বলতে পারে, ‘হ্যালো বাবা কেমন আছো’। সে একটি রুলারকে ফোন বানিয়ে ফেলে শুধু খেলার জন্য। এগুলো খুবই প্রচলিত একটি খেলা সাধারণ শিশুদের ভেতর। কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশুর মধ্যে এ অভিনয় করে এ ধরনের খেলাগুলো দেখা যায় না বা কম দেখা যায়।

অনেক বাচ্চা শারীরিক স্পর্শ পছন্দ করে না। যখন শিশুটিকে আদর করা হয়, সে তা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে না। সেখান থেকে সরে যায়। সাধারণ শিশুদের চাইতে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মনোযোগও একটু কমই থাকে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুটির ভেতরে অস্থিরতা থাকবে, অনেকাংশে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারবে না, এদিক-ওদিক ভাগতে থাকবে।

অনেক সময় নিজেকে আঘাত করার কিছু ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য চলে আসে তাদের ভেতর। তারা যে শুধু নিজেদের আঘাত করে তা-ই নয়, অন্যকেও আঘাত করতে পারে। কারণ হিসেবে দেখা যায়, সে তার নিজস্ব চাহিদাগুলো ঠিকমত প্রকাশ করতে পারে না। এসব ব্যবহারের ভেতরে- ধাক্কা দেওয়া, মার দেওয়া, কামড় দেওয়া, এগুলো দেখা যায়।

আসলেই ‘অটিজমে আক্রান্ত ও দেরিতে কথা বলা’- দুটোর ভেতর অনেক পার্থক্য আছে। সুতরাং যখন এ ধরনের সমস্যাগুলো একটু দেরিতে কথা বলা শিশুর মধ্যে দেখা যায়; তখন বুঝতে হবে শিশুটি দেরিতে কথা বলার সাথে সাথে অটিজমের লক্ষণগুলো বহন করছে।

আমরা যখন শিশুটিকে অ্যাসেসমেন্ট করার চেষ্টা করি, যে শিশুটি দেরিতে কথা বলছে না- অটিজমে আক্রান্ত- এ বিষয়ে পারিবারিক হিস্ট্রি নেওয়ার সময় ঠিকই চলে আসে যে, বাবা-মা’র পরিবারের কেউ দেরিতে কথা বলতো কি না? সে বিশ্বাস নিয়েই তারা আছেন।

এখন আমরা ঠিকই বুঝতে পারবো, দেরিতে কথা বলা আর অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো বহন করা দুটোর মধ্যে কিছু পার্থক্য অবশ্যই আছে। বাবা হয়তো দেরিতে কথা বলতেন কিন্তু সে অটিজমের কোনো বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ বহন করেননি। সে খেলাধুলায় প্রচণ্ড পারদর্শী ছিলেন, পড়াশোনায় দূরদর্শী ছিলেন, সামাজিকভাবেও খুব মিশতে পারতেন। সেক্ষেত্রে আমরা তাকে ‘দেরিতে কথা বলছে’ বলতে পারি। কিন্তু যখন শিশুর ভেতরে দেরিতে কথা বলার সাথে সাথে অন্যান্য কিছু আচরণ ও ব্যবহার জনিত বৈশিষ্ট্যগুলো চলে আসে; তখন আমরা অবশ্যই বলতে পারি শিশুটির মধ্যে অটিজমের লক্ষণসমূহ আছে।

দ্রুত ইন্টারভেনশন বা খুব তাড়াতাড়ি অ্যাসেসমেন্ট করে থেরাপি শুরু করলে অবশ্যই এক্ষেত্রে উপকার পাওয়া সম্ভব। আমরা অধিকাংশ সময় একজন থেরাপিস্ট বা হেলথ প্রফেশনালের সহযোগিতায় এ ধরনের সমস্যা থেকে সরে আসতে পারি। শিশুটিকে অনেকাংশেই স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়, পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় দিয়ে পারিবারিক পরিবেশে। আর এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে বিকাশ ব্যাহত হলে বা বিলম্বিত হলে অতিসত্বর একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো উপদেশগুলো গ্রহণ করা ও কার্যকর করা যায়।

 

আরপি/টিএস-০১



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top