শ্রীলঙ্কায় জাহাজ ভেড়ানোর পর এবার পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাতে চায় চীন
![সংগৃহিত](https://rajshahipost.com/uploads/shares/5720-2022-08-17-20-58-04.jpg)
নিজেদের উচ্চাভিলাষী আন্তর্জাতিক প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াকে নিজের বলয়ে নিয়ে আসতে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে তৎপরতা চালাচ্ছে চীন। সম্প্রতি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নিজেদের সেনাসদস্যদের পাঠাতে চাইছে দেশটি।
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে এখনও আলোচনা না করলেও ইতোমধ্যে পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে চীনের সরকার।
পাকিস্তান থেকে অবশ্য এখনও এ বিষয়ে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক- কোনো সাড়া আসেনি। তবে এ বিষয়ে চীনে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে জানা গেছে।
এশিয়া অঞ্চলের ২৪টি সংবাদমাধ্যমের জোট এশিয়ান নিউজ নেটওয়ার্কের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
এই কয়েক দিন আগেই শ্রীলঙ্কার বন্দরে সামরিক জাহাজ নোঙ্গরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারতকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছিল। ভারতের আপত্তির কারণে প্রথমে চীনকে জাহাজ ভেড়ানোর অনুমোদন দেয়নি শ্রীলঙ্কা, কিন্তু পরে দেশটির সরকার এ বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তনের পর গত ১৬ আগস্ট শ্রীলঙ্কায় নিজেদের নির্মিত হাম্বানটোটা বন্দরে এসে উপস্থিত হয় ট্র্যাক স্যাটেলাইট ও আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র সমৃদ্ধ চীনা নজরদারি জাহাজ ইউয়ান ওয়াং-৫।
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যাপক চাপে থাকা দক্ষিন এশিয়ার দুই দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। পাকিস্তানে বর্তমানে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার।
তাছাড়া এ দু’টি দেশ, বিশেষ করে পাকিস্তান কেবল আর্থিকভাবেই চীনের কাছে আবদ্ধ— এমন নয়। সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও বেইজিংয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইসলামাবাদ।
তবে পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সেনা পাঠানোর যে প্রস্তাব সম্প্রতি চীন দিয়েছে, তাতে পাকিস্তানে আর্থিক বিনিয়োগের পরিবর্তে পাকিস্তানের সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাই মূল প্রভাব রেখেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
কারণ, এ বিষয়ে চীনের সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়ালি ভুট্টো জারদারির সঙ্গে যেমন বৈঠক করেছেন, তেমনি আলোচনা করেছেন পাক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গেও।
তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের সঙ্গে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। তবে দেশটিকে নিয়ে চীন ও পাকিস্তান— উভয়ই উদ্বিগ্ন।
উদ্বেগের কারণ, এতদিন চীন ও পাকিস্তান— উভয়েরই বিশ্বাস ছিল, স্থলবেষ্টিত দেশ আফগানিস্তান সবসময় পাকিস্তান ও চীনের প্রতি নিঃশর্তভাবে অনুগত থাকবে। কিন্তু তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্প্রতি ভারতের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়তে থাকাই চীন ও পাকিস্তানের মাথাব্যাথার প্রধান কারণ।
তবে তারপরও বর্তমানে পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত নং রং, যিনি গত মার্চের পর থেকে দীর্ঘদিন পাকিস্তানের বাইরে ছুটিতে ছিলেন, তিনি সম্প্রতি আবার ফিরে এসেছেন ইসলামাবাদে; এবং ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠকও করেছেন।
পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রধান কারণ— দেশটিতে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা সংকট। গত বছর পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর দাসুতে চীনের মেগা প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোডস ইনিশিয়েটিভসের আওতাধীন একটি স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই হামলায় নিহত হন ১০ জন চীনা নাগরিক।
চলতি বছর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস সেন্টারে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি। সেই হামলায় নিহত হয়েছেন তিন চীনা নাগরিক।
এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় চীনের স্থাপনা ও নাগরিকদের ওপর হামলায় গত দুই বছরে ২০ জনেরও বেশি চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ মূলত পাকিস্তান-মধ্যএশিয়ার সঙ্গে চীনের সরাসরি সড়ক সংযোগ প্রকল্প। সড়ক নির্মাণের পাশপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ প্রভৃতি স্থাপনাও পাকিস্তানে নির্মাণ করা হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়।
বিপুল এই মেগা প্রকল্পে কর্মরত কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে চীন সরকারের উদ্বেগ তাই স্বাভাবিক।
তবে পাকিস্তানের সরকারের আশঙ্কা, চীনের এই অনুরোধ মেনে নিলে, অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে চীনের সেনাসদস্যদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে।
তাছাড়া, চীনের এই অনুরোধ মেনে নিলে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির শঙ্কাও রয়েছে। পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাধী ও কট্টরপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী যদি জনগণের এই মনোভাবকে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহার শুরু করে, তাহলে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তানের নাজুক রাজনীতি আরও টালমাটাল হয়ে উঠবে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে এশিয়ান নিউজ নেটওয়ার্ককে বলেন, ‘পাকিস্তানে পিপলস লিবারেশন আর্মির (চীনের সামরিক বাহিনী) সেনাসদস্যদের পাঠাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চীন।’
আরপি/ এসএইচ ১৩
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: