রাজশাহী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


ক্রমশ বেপরোয়া হচ্ছে রাবি ছাত্রলীগ


প্রকাশিত:
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৭

আপডেট:
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:২৩

ফাইল ছবি

ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আচরণ। একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতন, হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, চাঁদাবাজি ও আবাসিক সিট দখলের মতো ঘটনার যেন লাগাম ধরার নেই কেউই। ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর কিংবা আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেকে বাদ যাচ্ছে না হল প্রাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

তথ্য মতে, ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ২০২১-২০২২ সালে অন্তত ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি হয়েছিল ১৩টির। তার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে মাত্র ৬টির। এছাড়া লিখিত অভিযোগ দেয়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক।

তবে লিখিত অভিযোগগুলোর কোনোটাতেই ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি রাবি প্রশাসন। দুই-একটি ঘটনার বিচার হলেও তা লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয় বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করছেন, শাস্তি না হওয়ায় আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য কমছে না। লাগামহীন অপকর্ম রোধে শাস্তির বিকল্প দেখছেন না তারা।

সর্বশেষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের এক শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রাধ্যাক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।

এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুরের অভিযোগ আসে ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ধাওয়া দিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক সৌমিক ও আতিক নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করে বিভাগের অফিসে নেওয়া হয়। পরে প্রক্টোরিয়াল বডির দুজন সদস্য, মতিহার থানার দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ফোকলোর বিভাগের সভাপতি ও শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করে ছাত্রলীগ সভাপতি ওই দুইজনকে নিয়ে যায়।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আসন দখল করতে প্রাথমিকভাবে আবাসিক হলের রুমে তালা মারতে শুরু করে ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাকর্মীরা। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করে। এই উপায়ে ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। এমনকি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হেনস্তার হাত থেকে রেহায় পান না ক্যাম্পাসে কাজ করা গণমাধ্যমকর্মীরাও।

যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছর বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ১ জুলাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে অবৈধদের বের করে দিয়ে বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হয়। এরমধ্যে ২০ শিক্ষার্থী এখনো হলেই আছেন। এরপর হলের সিট দখলের দৌরাত্ম্য কমতে থাকে। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার আবারও এমন ঘটনা ঘটল আবাসিক হলে।

আলোচিত কিছু ঘটনা

গত ১৯ জানুয়ারি রাত ১১টায় রাবির শাহ মাখদুম হলের ২১৪ নম্বর কক্ষের এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে মারধর করে মানিব্যাগ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল একই হলের ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান অপূর্বের বিরুদ্ধে। বিষয়টি কাউকে বললে প্রাণনাশের হুমকিও দেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। এ ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।

এর তিনদিন পর গত ২২ জানুয়ারি রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বিছানাপত্রসহ এক শিক্ষার্থীকে নামিয়ে দেয় ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিন ইসলাম ও তার অনুসারীরা। পরে সেই সিটে আরেকজনকে তুলে দেয় মোমিন। বিষয়টি একাধিকবার হল প্রাধ্যক্ষকে জানালেও সমাধান না পেয়ে বিছানাপত্র নিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেন ওই শিক্ষার্থী।

গত বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে বের করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী। পরে তিনি গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রক্টরের দপ্তরে অভিযোগ সংবলিত একটি চিঠি কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠান। ওই শিক্ষার্থীকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়। তার অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তার ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নেন।

গত বছরের ১৯ আগস্ট মতিহার হলে চাঁদা না দেওয়ায় অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফাটানোর অভিযোগ আসে ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহার বিরুদ্ধে। হল কক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে মারধর করা হয় তাকে। এক পর্যায়ে হুমকি দিয়ে বলা হয়, কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে।

তদন্ত কমিটিতেই দায়িত্ব শেষ প্রশাসনের!

হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মারধরের মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও কোনো ক্ষেত্রেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি রাবি প্রশাসনকে। ওপরের ঘটনাগুলোর তদন্ত কমিটি হলেও প্রতিবেদনের মুখ দেখা যায়নি।

রাবি প্রশাসনের তথ্যমতে, করোনার পর অন্তত ২৩টি ঘটনায় শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টরের দপ্তর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে বলে জানা রয়েছে। তবে একটি ঘটনায়ও ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্ব, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন রাবি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, প্রতীকী অনশনে বসেছেন তিনি। গত বছরের ২৬ জুন তিনি প্রশাসন ভবনের সামনে শামসুজ্জোহা চত্বরে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ছাত্রলীগের এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেরাও ভাবছি। তাদের এমন ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডে আমরা অসহায় অনুভব করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্রলীগের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতাশাজনক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যার কারণে এগুলো আরও বেপরোয়াভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আমরা ভাবছিলাম এই বিষয়গুলোতে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাবে। এখন দেখছি তারা ছাত্রলীগের মাথায় হাত বুলিয়ে চলছে। কোনো অপকর্মের পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। সামনে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে।

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক জানান, তারা অনেকগুলো বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। সেগুলো শিগগিরই ডিসিপ্লিন কমিটিতে যাবে। এরমধ্যে অনেকেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় শাস্তি হলে হলগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমবে বলে আশাবাদী তিনিও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, আমরা এসব বিষয়ে সচেষ্ট আছি। ছাত্র নির্যাতন ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের প্রতিরোধ বিষয়ে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। দুই-একদিনের মধ্যে এ কমিটির সদস্যরা আলোচনায় বসবেন এবং কিভাবে এর প্রতিকার করা যায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই আমাদের কাছে সমান। যদি কোনো শিক্ষার্থী অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে সে যেই হোক তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত অনুযায়ী সত্যতা মিললে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ ফয়সাল আহমেদ রুনুর সাথে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, গত ১২ ফেব্রুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ওই ঘটনা সত্য নয়। সেখানে আমাদের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী ছিল। সে বাড়ি যাওয়ার কারণে একজন অনাবাসিক শিক্ষার্থী উঠেছিল। সে বিষয়ে ছাত্রলীগের যারা নেতা ছিল তারা কথা বলতে গিয়েছিল। এ সময় ভুল বোঝাবুঝি হয়, পরবর্তীতে আমি তাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি ঠিক করে দেই। কাউকে কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি।

শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর ও নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, না, এরকম ঘটনা সত্য নয়। তবে কিছুক্ষণ আগে শুনলাম ওই ছেলে প্রক্টর বরাবর অভিযোগ দিয়েছে।

ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ঘটনার সাথে ছাত্রলীগ জড়িত নাই বলে আমি জানি। এ বিষয়ে কেউ কিছু বলেও নি, আমি অবগত নই।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে কারো কিছু করার সুযোগ নাই। আর কেউ যদি নাম ব্যবহার করে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

আরপি/ এমএএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top