রাজশাহী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

দশ বছর ধরে মিথ্যা মামলার ঘানি টানছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা!


প্রকাশিত:
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৪১

আপডেট:
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:১১

ছবি: সংবাদ সম্মেলন

রাজশাহীতে ১০ বছর ধরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের এক মামলার ঘানি টানছেন মনজুর রহমান (৭০) নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার দাবি, মামলাটি মিথ্যা। জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় শত্রুতা করে একই গ্রামের এক মাদক কারবারি তাঁকে ফাঁসিয়েছেন। মামলার হাজিরা দিতে দিতে তিনি এখন ক্লান্ত। আর তাই মামলা থেকে মুক্তি পেতে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টিও কামনা করেন তিনি।

শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে 'মিথ্যা’ মামলা থেকে মুক্তির আকুতি জানান তিনি।

মনজুর রহমান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গোদাগাড়ী উপজেলা শাখার সাবেক সহকারী কমান্ডার (ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক)।

ঘটনার বিবরণে বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুর রহমান জানান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাবার জন্য ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বাসে চড়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন। ওই বাসে তার পেছন দিকে ছিলেন একই গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। বাসটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে সাদা পোশাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্য গাড়িটির গতিরোধ করেন। এরপর একজন লুঙ্গি পরিহিত এক দালাল গাড়িতে উঠে সরাসরি মনজুর রহমানের সামনে দাঁড়ান এবং তার ট্রাভেল ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালান। কিন্তু ব্যাগে কাগজপত্র ছাড়া কিছুই পাননি। এরপর বাসের পেছনে বসা রবিউলের ব্যাগ তল্লাশি করে ফেনসিডিল পাওয়ায় তাকে গাড়ির নিচে নামানো হয়। পরে ওই দালাল বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুর রহমানকেও বাস থেকে নামিয়ে আনেন।

মনজুর রহমান বলেন, ‘এই ফেনসিডিলের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু রবিউলের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ থাকায় সে আমাকেও ফাঁসিয়ে দেয়। বলে, ওই ফেনসিডিলে নাকি আমারও মালিকানা আছে। আমি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকদের বলি- আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে ভালবেসে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। সেই দেশের ক্ষতি করতে আমি এই অবৈধ ব্যবসা করতে পারি না। আমি তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সনদপত্রের ফটোকপি দেখাই। একজন উপ-পরিদর্শক পদের লোক সনদপত্রটি পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেন। আর রেগে গিয়ে তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাম শুনলে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়।”

মনজুর রহমান আরও জানান, সেদিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক পদের এক কর্মকর্তা প্যান্টের পকেট থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ৭০০ টাকা ছিনিয়ে নেন। আমাকে মামলায় না জড়ানোর অনুরোধ করলে ৪ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিতে পারায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন আমাকে মামলায় জড়ান।

তিনি বলেন, ‘রবিউলের ব্যাগে মোট ৬০ বোতল ফেনসিডিল ছিল। আমাকে মামলায় জড়াতে অধিদপ্তরের লোকেরাই তাদের কাভার্ড ভ্যান থেকে দুটি ব্যাগ আনে। দুই ব্যাগে ২৫টি করে ফেনসিডিল ঢুকিয়ে আমার আর রবিউলের কাছে ব্যাগ দুটি পাওয়া গেছে দেখিয়ে মামলা করে। আর ১০টি ফেনসিডিল দেওয়া হয় ওই দালালকে। ওই সময় আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া টাকা আমি ফেরত পাইনি। ২০২০ সালে আসামি রবিউল ইসলাম মারা গেছেন।

তিনি আরও জানান, সেদিন মনজুর ও রবিউলকে দুপুরে নগরীর মতিহার থানায় সোপর্দ করেন মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা। পরে পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান। তিনমাস হাজতে থাকার পর মনজুর রহমান জামিনে বের হন। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাটি রাজশাহী বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে চলমান। মামলা নম্বর-৪৯৯। ২০১৪ থেকে ২০২৪- এই দশ বছরে হাজিরা দিতে দিতে তিনি নিঃশ্ব-সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। এই মামলার কারণে বৃদ্ধ বয়সে তিনি সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন হন। তিনি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান।

মনজুর রহমান বলেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য অস্ত্র তুলে নিয়ে আমি ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ও ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করি জীবন বাজি রেখে। সেই দেশে ১০ বছর ধরে আমাকেই মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এই মিথ্যা মামলা থাকার কারণে লজ্জায় আমার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করে। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে তা পারি না।’

মনজুর রহমান সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার কষ্টের কথা পৌঁছালে আমি ন্যায় বিচার পাব। তিনি তাঁর নির্বাহী আদেশের বলে এই মামলা থেকে আমাকে মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। তাহলে আমি আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারব। তা না হলে কষ্ট নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে।’

 

 

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top