কলেজশিক্ষিকার এমপিও নিয়ে তদবির, উপপরিচালকের কল রেকর্ড ফাঁস!
কামরুন্নাহার বেগম। তিনি নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষিকা। গত সেপ্টেম্বর মাসে ওই কলেজে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন তিনি।
এর আগে গত জুন মাসেও এমপিওভুক্তির আবেদন করেছিলেন তিনি। তবে নিবন্ধন সনদ জটিলতার কারণে সেই আবেদন বাতিল করেছিলেন আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (মাউশি) দপ্তরের পরিচালক। তিন মাসের মাথায় একই প্রার্থীকে এমপিওভুক্তি জন্ম দিয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
জানা যায়, মাউশির নির্দেশনানুযায়ী ফের এমপিও আবেদন করেন তিনি। তবে এবার আবেদনের পরপরই এমপিও পেতে শুরু হয় জোর তদবির। কামরুন্নাহারের মামা মকবুল হোসেন আঞ্চলিক শিক্ষা দপ্তরের উপ-পরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহর সঙ্গে এ বিষয়ে মোবাইলে যোগাযোগ করেন।
ইতোমধ্যে তাদের কথোপকথনের সেই রেকর্ড সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরই তোলপাড় উঠেছে এই অঞ্চলের শিক্ষক মহলে। সামনে আসতে শুরু করেছে আঞ্চলিক শিক্ষা দপ্তরের নানান অপকর্ম। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেকের থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও উঠেছে এই আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের কর্তাদের বিরুদ্ধে।
ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডে শোনা যায়, টানা ছয় বার সালাম দেওয়ার পর সালাম গ্রহণ করেন উপ-পরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহ। নিজেকে নাটোরের পাঁকা কলেজের সহকারী অধ্যাপক পরিচয় দিয়ে তিনি স্মরণ করে দেন, গোপালপুর ডিগ্রি কলেজের কামরুন্নাহারের কাগজ জমা দেওয়ার বিষয়টি।
জবাবে উপ-পরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহ বলছেন, ‘আপনাকে তো বলেছি কাজটা করে দিবো আমি। কিন্তু আপনি তো পরিচালক-সহকারী পরিচালক সম্পর্কে জানেন সবই। তারা তো এমনি এমনি কাজ করতে চায় না, এইটা মূল সমস্যা। আমি না হয় আমার কাজটা করে দিলাম। কিন্তু ওখানে পার হওয়ার জন্য আপনাকে কিছুটা সেক্রিফাইস করতেই হবে।’
জানা যায়, এমপিও প্রার্থী কামরুন্নাহারের মামা মকবুল হোসেন পেশায় কলেজ শিক্ষক। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তিনি। কল রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি তিনি। তার দাবি, এই কথোপকথন তার রেকর্ড করা নয়। এটি তিনি ছড়াননি।
কামরুন্নাহারের এমপিও পেতে তদবির করার বিষয়টি স্বীকার করে মকবুল হোসেন জানান, কামরুন্নাহার তার ভাগ্নি। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। কলেজের পাশেই তার শ্বশুরবাড়ি। ভাগনির এমপিওর বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন।
তিনি আরও জানান, গত জুন মাসে তার ভাগ্নি এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু সেই আবেদন দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁলে ছিল। অনলাইনে তিনি দেখতে পান সেটি উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ এর কাছে আছে। পরে তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন। তবে ফাইল ছেড়ে দিতে তিনি অর্থ চাননি বলেও দাবি এই শিক্ষকের।
আলোচিত সেই শিক্ষিকা কামরুন্নাহার জানান, কলেজশিক্ষক মকবুল হোসেন তার মায়ের ‘কাজিন’। সেই হিসেবে তাকে এমপিওর বিষয়টি দেখভাল করতে বলা হয়েছিল। তার এমপিও পেতে কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি।
তিনি দাবি করেন, তার এনটিআরসিএ নিবন্ধন ২০০৬ সালে। এমপিও আবেদনের পর আঞ্চলিক শিক্ষা দপ্তর জানিয়েছিল তারা সনদ অনলাইনে পাচ্ছে না। কারণ ওই সময় এনটিআরসিএর অনলাইন ডাটাবেজে এই তথ্য ছিল না। পরে বিষয়টি রিভিউ করে নিস্পত্তি হয়েছে। এই সমস্যা শুধু তার একার নয়, আরও অনেকেরই ছিল।
এদিকে, কামরুন্নাহারের এমপিও আবেদন যে সময় হয়েছিল, সেই সময় গোপালপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আকরাম হোসেন। চলতি বছরের ১৯ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। পরে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নূরুন্নবী।
নূরুন্নবী জানান, কামরুন্নাহারসহ ডিগ্রি পর্যায়ের সাত জন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কামরুন্নাহারসহ দুজনের এমপিও আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়। কারণ দেখানো হয়, তাদের এনটিআরসিএর নিবন্ধন সনদ সঠিক নয়। এটি যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যক্ষকেই। সেই হিসেবে তিনি নিজেই এনটিআরসিএ থেকে দুজনের সনদ যাচাই করে আনেন।
পরে একসঙ্গে তাদের এমপিও আবেদন হয়। ওই সময় একজনের আবেদন নিস্পত্তি হলেও ঝুঁলে ছিল কামরুন্নাহারের আবেদন। সর্বশেষ এমপিওতে সেই আবেদনও নিস্পত্তি হয়েছে।
এমপিও ভুক্তিতে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জানান, বিধি মেনে তারা অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। এরপর শিক্ষকরা নিজেদের মতো যোগাযোগ করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। তার কাছে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের উপ-পরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহ জানান, পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে ফোনে না পেয়ে তাকে প্রতিদিনই অসংখ্য শিক্ষক ফোন দেন। তিনি নিজের জায়গা থেকে শিক্ষকদের হাসিমুখে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি জানান, এমপিও আবেদন নিস্পত্তি করার ক্ষমতা তার নেই। ফলে এমপিও পাইয়ে দিতে অর্থ দাবির বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন।
আর ফাইল আটকে রাখার বিষয়ে তিনি জানান, এমপিও শেষে সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক এবং পরিচালকের কাছে কিছু ফাইল আটকে থাকে। সময় সল্পতার কারণে এটি হয়। পর্যায়ক্রমে এসব আবেদন নিস্পত্তি করেন তারা। ওই শিক্ষকের আবেদনও এর মধ্যে থাকতে পারে।
উপ-পরিচালকের অভিযোগ, সম্প্রতি দুই দফা পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন এবং সহকারী পরিচালক ড. আবু রেজা আজাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের তদন্ত হয়েছে। তারা শাস্তির মুখে পড়েছেন। এই পস্থিতিতে আমার নামে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তারা।
তবে উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ বিষয়ে জানতে একাধিক বার চেষ্টা করেও পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক ড. আবু রেজা আজাদের মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরপি/ এসএইচ 02
বিষয়: কলেজ শিক্ষিকা উপপরিচালক অপরাধ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: