রাজশাহী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


আর মাত্র ১০ টি গোল দূরে রোনালদো


প্রকাশিত:
২০ জুন ২০২০ ১৮:২২

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৪:২৩

ফাইল ছবি

পর্তুগাল-স্পেন সীমান্তের চাভেস নামক জায়গার এস্তাদিও মিউনিসিপাল এনহেনহিয়েরো ম্যানুয়েল ব্রাঙ্কো তেইজেরিয়া স্টেডিয়ামের ভেতর অবস্থান করছিল ৮ হাজার মানুষ। তখন থেকেই শুরু হলো কিংবদন্তি ফুটবলারের পথচলা।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকটা পর্তুগাল ফুটবলের জন্য ভালো ছিল না। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায়। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৯ জন খেলোয়াড় নিয়ে খেলেছিল পর্তুগাল। ফরোয়ার্ড হোয়াও পিন্টো রেফারিকে ঘুষি মেরে লাল কার্ড দেখেছিলেন।

২০০৪ ইউরো কাপের স্বাগতিক দেশ কাজাখাস্তান। তার আগে ২০০৩ সালের আগস্টে কাজাখাস্তানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলতে নামে পর্তুগাল। ম্যাচের হাফ টাইমে স্কোরলাইন ছিল গোলশূন্য। বিরতির পর মাঠে নামেন ১৮ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তাকে মাঠে বসেই তখনকার অধিনায়ক লুইস ফিগো বলছিলেন, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। ক্লাবে যেমন করে খেলে যাও, এখানেও তেমনি করে খেলতে থাকো।’

মাত্র দুই মিনিটের মাথায় রোনালদোর ড্রিবলিং, বল নিয়ে কাড়িকুড়ি দেখে স্টেডিয়ামের দর্শকরা ‘রোনালদো’ ‘রোনালদো’ ধ্বনিতে মুখরিত হতে লাগল। পুরো ম্যাচে রোনালদো অসাধারণ খেললেন। দল জিতল ১-০ গোলে। রোনালদো অর্জন করলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। এভাবেই তিনি বিশ্বসেরা হওয়ার রাস্তায় পদার্পণ করেন বীরের বেশে।

সেই ম্যাচে রোনালদোর সতীর্থ ছিলেন ফার্নান্দো মিয়েরা। ‘সে ইতোমধ্যেই সেরা হওয়ার দৌড়ে নেমে পড়েছে। সে ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন, শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে চায়। সে সবদিক দিয়েই সেরা হতে চায়’- সেই ম্যাচের পর মিয়েরার এই কথার প্রতিফলন বোঝা গেল ১৭ বছর পর।

পাঁচবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী, পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী, জাতীয় বীর, পর্তুগালের ২০১৬ ইউরো জয়ের কাণ্ডারি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সর্বোপরি শীগগিরই তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার মুকুটও অর্জন করতে যাচ্ছেন।

রোনালদো তার সময়ে ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্বের সব বাঘা বাঘা কিংবদন্তিদের। লিওনেল মেসি, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ব্রাজিলিয়ান রোনালদো এবং ফুটবলের সর্বকালের সেরা পেলের থেকেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জার্সি গায়ে রোনালদোর গোল সংখ্যা বেশি। জাতীয় দলের হয়ে ৯৯ গোল তার। মাত্র ১০ গোল সামনে রয়েছে আলি দাই। রোনালদো একবার বলেছিলেন, ‘রেকর্ড আমার জীবনেরই অংশ। আমি রেকর্ডকে অনুসরণ করি না।’

জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগে রোনালদোর বিধ্বংসী রূপ দেখেছিল ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দল, ২০০৩ সালের মার্চ মাসে। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন জো কোল, জার্মেইন ডেফো, মাইকেল ক্যারিক, গ্যারাথ ব্যারির মতো তারকা ফুটবলাররা। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ধরাশায়ী করে ছেড়েছিল পর্তুগাল। রোনালদো শুধু একাই নয়, রিকার্ডো কোয়ারেজমার বদৌলতে ইংল্যান্ডকে ৪-২ গোলে হারায় তারা।

ইংল্যান্ডের হয়ে সেই ম্যাচে খেলেছিলেন ডেভিড প্রুটন। ম্যাচ শেষে বলেন, ‘আমাদের রোনালদো কিংবা কোয়ারেজমা মানের কোন ফুটবলারই দলে নেই। রোনালদোকে নিয়ে আমাদের আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। রোনালদোকে দেখতে অপরিপক্ব মনে হয়েছিল কিন্তু সে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে আমাদেরকে হারিয়ে দিল।

ম্যাচের একটা মুহূর্ত ছিল টাচলাইনের সঙ্গে। তাকে আমরা কয়েকজন খেলোয়াড় মিলে ঘিরে ধরেছিলাম। কোনভাবেই তার সেখান থেকে বল নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু সে সবাইকে চমকে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বল নিয়ে। আমার তখনই মনে হয়েছিল, আমি একজন স্পেশাল মানুষের সঙ্গে খেলছি।’

পর্তুগাল পরবর্তীতে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো টুর্নামেন্টে জায়গা করে নেয়। ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে পর্তুগাল অনুর্ধ্ব-২০ তলুন টুর্নামেন্ট জয়লাভ করে। ইউরোপের কম করে হলেও ৬টি ক্লাবের স্কাউট তার খেলা দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিল। ১৫ বছর বয়সে বুকের অসুখের জন্য রোনালদোকে লেজার সার্জারি নিতে হয়েছিল। সেটিকে পরাস্ত করে রোনালদো স্পোর্টিং লিসবনের মূল দলে জায়গা করে নেন ২০০২-০৩ মৌসুমে।

আর্সেনাল কয়েকবারই তাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। রোনালদোর এজেন্ট জর্জ মেন্দেস জানুয়ারির দিকে আর্সেনালের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে এক গোপন বৈঠক করেছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গারের সঙ্গে। রোনালদো সে ব্যাপারে বলেন, ‘আমরা একটা গাড়িতে ছিলাম এবং জর্জ মেন্ডেস আমাকে ফোন করে বারবার বলে যাচ্ছিল যেন আমাকে কেউ না দেখে।

আমরা একটি সার্ভিস স্টেশনে পৌছাই এবং আমাকে আমার চেহারা পুরোটাই মুখোশ দিয়ে আটকে রাখতে হয়েছিল। জর্জ আমাকে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ফোন করে বলে যাচ্ছিল, সাবধান! সাবধান! তোমার চারপাশে অনেক মানুষ আছে।’

কিন্তু আর্সেনাল স্পোর্টিং লিসবনের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি। লিভারপুলের হয়ে ১৯৯৮-২০০৪ সাল পর্যন্ত কোচিং করানো ফ্রেঞ্চ কোচ জেরার্ড হোলিংয়েরও রোনালদোকে লিভারপুলে আনতে চেয়েছিলেন।

শুধুমাত্র মেন্দেসের স্যালারি নিয়ে বিপত্তি ঘটায় রোনালদোর আর লিভারপুলে আসা হয়নি। বার্সেলোনাও রোনালদোকে সাইন করাতে চেয়েছিল কিন্তু রোনালদোর থেকে তারা কোয়ারেজমাকে বেশি পছন্দ করেছিল কারণ কোয়ারেজমা একটু বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ ছিলেন।

তখনকার দিনে রোনালদোর চেয়ে কোয়ারেজমাকে অনেকেই ভালো খেলোয়াড় বলেছিল। পর্তুগালের প্রেস অফিসার পেরেরা বলেছিল, ‘আমি কোয়ারেজমাকে অনুশীলনে একদিন দেখেছিলাম। তারপরের দিন যখন আবার দেখলাম তখন সে বিস্ময়কর এক প্রতিভা।’

অনূর্ধ্ব-১৭'র এক ম্যাচ শেষে স্পোর্টিংয়ের প্রধান স্কাউট পেরেরাকে বলেছিলেন, ‘শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি। কোয়ারেজমা এবং রোনালদোর ভেতর মাদেইরার রোনালদোই সাফল্য পাবে। সে পেশাদার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সে পেশাদারদের থেকে অধিকতর পেশাদার ফুটবলার।’

কোয়ারেজমা ২০০৩ সালে স্পোর্টিং ছাড়ার পর তখন দলটির কোচ হয়ে আসেন ফার্নান্দো সান্তোস। যেই সান্তোসের অধীনে পর্তুগাল ২০১৬ সালের ইউরো কাপ জয় লাভ করেছে। সান্তোস রোনালদোকে দলের মূল খেলোয়াড় করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সময়ের সাথে সেই পরিকল্পনাগুলো অতো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

রোনালদোর আরেকজন প্রশংসাকারী ছিলেন পর্তুগজি কোচ কার্লোস কুইরোজ। যিনি ২০০৩ সালের দিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সহকারী কোচের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিই মূলত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে রোনালদোর চুক্তি করতে সহায়তা করেন।

লিসবনের নতুন স্টেডিয়ামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় ২০০৩ সালের আগস্টের ৬ তারিখ। ইউনাইটেড যুক্তরাষ্ট্রে জুভেন্টাস এবং বার্সেলোনাকে হারিয়ে লিসবনে চলে আসে। লিসবনে ইউনাইটেড পেল রোনালদোর হাতে তিক্ত হারের অভিজ্ঞতা।

ইউনাইটেডের সেই পরাজিত দলের সদস্য কুইন্টন ফরচুন ম্যাচ শেষে বলেন, ‘আমি তার নামটা পর্যন্ত শুনিনি এই ম্যাচের আগে। তার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। সে অসাধারণ ছিল। ভাগ্যপ্রসূত আমি লেফট ব্যাকে এবং জন ও’শেয়া রাইট ব্যাকে খেলেছিল।

রোনালদো খেলেছিল আমার সাইডে। আমি শুধু আশা করছিলাম যাতে সে আমাকে কোনভাবে পরাস্ত না করতে পারে। সে আমাকে অনায়াসে পরাস্ত করল, গোলে এসিস্ট করল। ড্রেসিংরুমে ও’শেয়ার দিকে তাকিয়ে আমরা বলাবলি করছিলাম, ‘এটা কি ছিল!’

এ ম্যাচের পর থেকে লিসবনের সঙ্গে ইউনাইটেড কথাবার্তা চালাচ্ছিল। ১২ মাসের লোনে রোনালদোকে ইউনাইটেডে আনার জন্য সব প্রায় পাকাপোক্ত তখন স্যার এলেক্স বাধ সাধলেন। তিনি রোনালদোকে তখনই তার দলে চাইলেন। স্যার এলেক্স ম্যাচ শেষেই বলেছিলেন, ‘পিটার কেনিয়নকে মাঠে পাঠাও। আমরা এখান থেকে যাচ্ছি না যতক্ষণ না আমরা রোনালদোকে সাইন করাতে পারছি।’

ম্যাচ শেষে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়রা বাসে দেড় ঘন্টার মত অপেক্ষা করছিল স্যার এলেক্সের জন্য। স্যার এলেক্স এবং কেনিয়ন স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে রোনালদোর ব্যাপারে কথা বলার অনুমতি পেলেন। তারা একটি ছোট্ট ড্রেসিংরুমে বসলেন রোনালদোকে রাজি করানোর জন্য।

রয় কিন মজা করে সেই সময়টার কথা মনে করে বলেন, ‘আমরা সবসময়ে জন ও’শেয়াকে নিয়ে মজা করতাম কারণ সেই এই ডিলটা করাতে সাহায্য করেছে মাঠে রোনালদোকে বাজে গালি দিয়ে।’

রোনালদোকে বিক্রি করাটা ফার্নান্দো সান্তোসের জন্য অনেক বড় ক্ষতি ছিল। পরবর্তীতে সান্তোসকে তার পুরো গেমপ্ল্যান বদলাতে হয়েছিল। সেই মৌসুমে লিসবন লিগে ৩য় হয় এবং সান্তোস বরখাস্ত হন।

লিসবন থেকে ইউনাইটেডে আসার ১০ দিনের মধ্যে ইউনাইটেডে রোনালদোর অভিষেক হয়। বোল্টনের বিপক্ষে ৩০ মিনিট খেলেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন রোনালদো। সেই ম্যাচের ৪ দিন পর পর্তুগালের জার্সি গায়ে কাজাখাস্তানের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়।

ইউনাইটেডে এসে কিছুটা নার্ভাস থাকলেও রোনালদোর আত্মবিশ্বাস ছিল দলের সঙ্গে বোঝাপোড়া নিয়ে। ‘যখন আমাদের মধ্যে কোন নতুন খেলোয়াড় আসে তখন আমরা তাকে ডিনারে ডাকি প্রথমদিনই। ডিনারে তাকে দাঁড় করিয়ে নিজের সম্পর্কে সবকিছু বলতে বলা হয়। সে কোনভাবেই কথা থামাচ্ছিল না। বলেই যাচ্ছিল ছিল। আমরা তাকে বললাম, আচ্ছা বালক ঠিকাছে, তুমি বসতে পারো’- ফার্নান্দো মিয়েরা বলেন।

রোনালদো যখন দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন, তখন দলের সবাই তার প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবে নজর দেয়। ‘সে অসাধারণ টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। সে আমাদের বলেছে, সে যখন প্রথম ইউনাইটেডে আসে তখন সতীর্থরা তাকে দুয়োধ্বনি দিচ্ছিল, তাকে নিয়ে কৌতুক করছিল কারণ সে রিও ফার্দিনান্দের সঙ্গে টেবিল টেনিসে হেরে গিয়েছিল।

সে এক মাস টেবিল টেনিস খেলেনি। এক সে টেবিল টেনিস কিনে বাসায় বসেই একা একা খেলা শুরু করে। সামান্য ঘটনাটাই আপনাকে বুঝিয়ে দিবে সে কতটা ক্ষুধার্ত। সে জাতীয় দল নিয়ে কখনওই উদ্বিগ্ন ছিল না’- বলছিলেন মিয়েরা।

পোর্তোর হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা মানিশের মতে রোনালদো তাস খেলাতেও অনেকটা এমন, ‘জাতীয় দলের হয়ে প্রথম দিকে সে আমার এবং ডেকোর সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে তাস খেলে। কত দেরিতে সে হারছে সেটা কোন বিষয় ছিল না। সে যদি হারতো তাহলে যতটা সম্ভব চেষ্টা করত সেখান থেকে হারানো টাকা উদ্ধার করতে।’

জাতীয় দলের হয়ে রোনালদোর প্রথম গোলটি আসে ইউরো কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে। এটি তার ৮ম ম্যাচ ছিল। লুই ফিলিপ স্কলারির দল বিরতির আগেই ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে রোনালদোর করা গোলটি কেবল ব্যবধানই কমিয়েছে।

ভালেন্তে বলেন, ‘প্রথমে সিমাও দলের হয়ে লেফট উইংয়ে শুরু করেছিল। পরে রোনালদোই সেই জায়গাটা দখল করে নেয়। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং নিজেকে প্রমাণ করার ব্যকুলতাই তাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে।’

টুর্নামেন্টে রোনালদোর আরেকটি হেড থেকে করা গোল পর্তুগালকে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় এনে দেয়ার পাশাপাশি সেমিফাইনালে তোলে। যদিও ফাইনালে গ্রিসের সঙ্গে হেরে কান্না বিজরিত বদনে মাঠ ছাড়তে হয় রোনালদোকে। রোনালদো সবসময়েই শুরু থেকে খেলতে চাইতো।

ডেকো বলেন, ‘সে শক্তিতে ভরপুর ছিল। আমি তার মত খেলোয়াড় দেখিনি। সে চাইলে একদিনে ৩টা ম্যাচ পর্যন্ত খেলতে পারে। সে সবসময়ে খেলাটাকে অন্য সবকিছু থেকে বেশি প্রাধান্য দেয়।’

কয়েক বছরের ভেতরে রোনালদোর ওয়ার্ক রেট কিংবদন্তিতুল্য হয়ে ওঠে। ভালেন্তে বলেন, ‘সে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পছন্দ করত। কিন্তু যেটি তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করত সেটি ছিল তার চিন্তাধারা এবং সেরা হওয়ার তাড়না।

সে সবসময় গোল করতে চাইত। আপনি তাকে জিম সেশনের ৪৫ মিনিট আগেই জিমে দেখতে পাবেন কারণ সে প্রতিনিয়ত নিজের উন্নতি করতে চাইত।’

দলে এমন একটা সময় আসত যখন রোনালদোকে বুঝতে হতো দলের চাহিদার ব্যাপারে। ভালেন্তে বলেন, ‘সে যখন দলে খেলত মাঝে মাঝে সে অনেক স্বতন্ত্রবাদী খেলা খেলত। তার খেলার ধরণ আমাদের দলের গেমপ্ল্যানের সঙ্গে সবসময় খাপ খেত না এবং আমরা তখন অনেক কথা বলতাম।

আমরা তাকে বলতাম যে, ম্যাচে তোমার এমন একটা সময় আসবে যখন ড্রিবল করতে পারবে। সবসময় এটা করার দরকার নেই।’

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও রোনালদোর সঙ্গে এসব কথাবার্তা হয় সতীর্থদের। প্রথম দুই মৌসুমে রোনালদো নিজেকে তেমন মেলে ধরতে পারেননি। কিন্তু তৃতীয় মৌসুমে এসেই তিনি প্রমাণ করেন ধৈর্যের ফল মধুর হয়।

ফরচুন বলেন, ‘প্রথম দিকে অনেক খেলোয়াড়কে বিপদে ফেলে দিয়েছিল। সে মাঠে শুধু স্কিল দেখানোর চেষ্টা করত। অন্যান্য কিশোর ফুটবলারদের থেকে রোনালদোর পার্থক্য ছিল তার আত্মবিশ্বাসে। সে নিজের ব্যাপারে সবসময়ে আশাবাদী ছিল যেমনটা ছিলেন মোহাম্মাদ আলি (কিংবদন্তি বক্সার)।

প্রথম যখন সে ইউনাইটেডে আসে তখন তার ইংলিশ অতো ভালো ছিল না। সে অনুশীলনের শেষে সবাইকে বলতে লাগল, ‘আমিই সেরা’। কিন্তু তাকে এটা বুঝতে কিছুদিন সময় কাটাতে হয় যে তার দক্ষতাকে গোল করানো, গোল করা কিংবা দারুণ ক্রস দেয়ার জায়গায় খাটাতে হবে। খেলোয়াড়রা তার ব্যাপারে আস্তে আস্তে হতাশ হয়ে যাচ্ছিল।

তারা ভাবছিল, হ্যাঁ তুমি সব অসাধারণ ড্রিবলিং এবং দক্ষতা প্রদর্শন করো কিন্তু তোমাকে তো এগুলা কাজে লাগাতে হবে।’

‘অনুশীলনে তার করা কয়েকটি ট্যাকেল তার সতীর্থদের দিকে এসেছিল। সবাই বেশ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তাকে পরবর্তীতে জানানো হয়, তুমি একা অনেক ভালো কিছু সেটা আমরা জানি কিন্তু দলের একজন সদস্য হিসেবে তোমাকে জানতে হবে কীভাবে আমাদের সঙ্গে খেলতে হয়।

এটাই তাকে দারুণ কিছু করতে উৎসাহ দিল। যদি তাকে কেউ একবার মারে তাকে আর পরবর্তীতে মারার দরকার পড়ে না। সে এমন ধাতুতে গড়া।’

২০০৬ বিশ্বকাপটা রোনালদোর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটি। বিশ্বকাপের ৯ মাস আগে তার বাবা মারা যান। রাশিয়ার বিপক্ষে মস্কোতে একটি ম্যাচ ছিল পর্তুগালের। লুই ফিলিপ স্কলারি বাবা মারা যাওয়ার খবর ড্রেসিংরুমে এসে ভগ্নহৃদয়ে রোনালদোকে জানান। রোনালদো তখন পারতেন সোজা প্লেনে চড়ে তার বাবাকে দেখতে চলে যেতে। তা না করে বরং রোনালদো ম্যাচটি খেলতে চাইলেন বাবাকে স্মরণ করে, বাবাকে উৎসর্গ করে। এমন ঘটনাই তাকে বিশ্বকাপে আরও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ইরানের বিপক্ষে গোল করার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অত্যধিক গরমের কারণে দ্রুত মাঠ ছাড়েন। পরের ম্যাচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি সুস্থ হয়েই মাঠে নামেন। ওয়েন রুনি সেই ম্যাচে ফাউল করে লাল কার্ড দেখাটা এখনও বেশ আলোচিত। সে রেফারিকে বলছিল যে ইচ্ছে করে মারেনি।

নিজের ক্লাব সতীর্থকে এভাবে লাল কার্ড দেখতে হবে এটা হয়তো ভাবেননি রোনালদো নিজেও। রুনির সঙ্গে হাতাহাতিও হয়েছিল রোনালদোর। ‘ইংল্যান্ডের সব জায়গাতে তখন এই ঘটনা হইচই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বেঞ্চ থেকে কেউ হয়তো তাকে কিছু বলেছিল যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’- বলেন ভালান্তে।

সেই ম্যাচে রোনালদো ট্রাইব্রেকারে জয়সূচক গোলটি করে বাবাকে স্মরণ করেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে রোনালদো অসাধারণ খেললেও পর্তুগাল হেরে যায় ১-০ গোলে। রোনালদোকে টুর্নামেটের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় হয়েই ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার একটু বাজে আচরণের জন্য ফিফা তাকে দেয়ার বদলে পুরস্কারটি দেয় লুকাস পোডোলস্কিকে।

ইংল্যান্ডে ‘আই হেইট রোনালদো’ জার্সি তখন সয়লাব হয়ে গেছিল। ডার্ট বোর্ডে রোনালদোর মাথা রাখা হতো এবং সবাই ডার্ট নিক্ষেপ করত সেখানে। ইউনাইটেডের হয়ে এওয়ে ম্যাচগুলো আরও বেশি তিক্ততায় ভরা ছিল। রোনালদো বলেছিলেন, ‘তারা আমাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে চায়। কিন্তু তারা কেবল সেরা খেলোয়াড়দের সাথেই এটা করতে পারে।

আমি সঠিক বলছি?’ সে প্রতিনিয়ত গোল করে সবাইকে চুপ করে দিত। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ২৩ গোল করে পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড় হন রোনালদো। ২০০৭-০৮ মৌসুমে ৪২ গোল করে রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে সহায়তা করেন।

ভালেন্তে বলেন, ‘২০০৬ সালটা তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার বছর। ইংল্যান্ডে সে প্রায়শই সমালোচনার সম্মুখীন হতো একা বল নিয়ে কাড়িকুড়ি করার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয় এটা তাকে অনেক সাহায্য করেছে। যতই সময় গিয়েছে ততই সে বুঝতে পেরেছে কোনটি দলের জন্য দরকারি। মাঠে তার একটাই ধ্যান ধারণা ছিল, সেটি ছিল গোল।’

ইউনাইটেডের হয়ে রোনালদো যতটা গোল পাচ্ছিলেন জাতীয় দলের হয়ে ততটা পাচ্ছিলেন না। সাংবাদিক সার্জিও ক্রিথিনাস ২০০৮ সালে বলেছিলেন, ‘পর্তুগালের সবাই রোনালদোকে নিয়ে সন্দিহান। কেননা ইউনাইটেডে অনেক গোল করতে পারলেও পর্তুগালে সে পারছে না। ইউনাইটেডে আক্রমণভাগের সহায়তায় সে হয়তো অনেক গোল করতে পারছে। পর্তুগালে এটা খুবই কঠিন’।

ফিফা ব্যালন ডি’অর জয়ের পর সবাই ধরে নিয়েছিল রোনালদো একাই ইউরো জেতাবে ২০০৮ সালে। মিডিয়া তার জাতীয় দলের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশ করতে লাগল। পুরো টুর্নামেন্টে গ্রুপপর্বে এক গোল করা ছাড়া আর কোন বলার মত পারফরম্যান্স করতে পারেননি রোনালদো।

কোয়ার্টারে জার্মানির বিপক্ষে হারের ম্যাচে নিজের ছায়া হয়েই ছিলেন তিনি। ম্যাচ শেষে স্কলারি কৌতুক করেই বলেছিল যে তার রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়া নিয়ে মিডিয়ার উচ্চবাচ্যই পারফরম্যান্সে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

কুইরোজ একসময় ইউনাইটেডের সহকারী কোচ ছিলেন। পরবর্তীতে পর্তুগালের কোচ হন। এটা রোনালদোর জন্য অতটা সুফল বয়ে আনেনি। কারণ ২০১০ বিশ্বকাপে মাত্র ১টি গোল করতে পেরেছিলেন রোনালদো। সেই বিশ্বকাপে স্পেনের সঙ্গে শেষ ষোলোতে হেরে বিদায় নেয় পর্তুগাল। ২৫ বছর বয়সে রোনালদো জাতীয় দলের হয়ে ৭৬ ম্যাচে করেন ২৩ গোল।

বিশ্বকাপের কয়েকদিন পর এক প্রীতি ম্যাচে স্পেনের বিপক্ষে রাগান্বিত হয়ে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন মাঠে। সে ম্যাচে জাতীয় দলের হয়ে তর্কসাপেক্ষে অন্যতম সেরা গোলটি থেকে রেফারি তাকে বঞ্চিত করে।

জেরার্ড পিকেকে দৌড়ে হারিয়ে, জাভি আলোন্সোকে কাটিয়ে ক্যাসিয়াসের মাথার ওপর দিয়ে শট মারলেও নানি হুট করে এসে সেই বলে মাথা লাগিয়ে বসেন। রেফারি সেটি অফসাইডের কারণ বাতিল করেন। রোনালদোর গোলটা হয়েই গেছিল, একদম দাগে যেয়ে নানি বলে টাচ করায় অফসাইডে বাতিল হয় গোলটি।

পর্তুগালের নতুন কোচ পাওলো বেন্টোর অধীনে ১১ ম্যাচে রোনালদো করেন ৯ গোল। সে মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে করেন ৫৩ গোল। ইউরো ২০১২তে গ্রুপপর্বে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও রোনালদোর জোড়া গোলে পর্তুগাল ড্র করে এবং গ্রুপে জার্মানির পর দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

পরে কোয়ার্টার ফাইনালে চেক রিপাবলিকের বিপক্ষে হেডে গোল করে দলকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেন রোনালদো। সেখানে স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে রোনালদোর সামনে সুযোগ ছিল দলকে ফাইনালে তোলার। কিন্তু তার সুযোগ আসার আগেই হোয়াও মৌতিনহো এবং ব্রুনো আলভেস শট মিস করায় রোনালদো আর ৫ম শটটি নিতে পারেননি। তার আগেই দল হেরে বিদায় নেয় সেমি থেকে।

২০১৩ সালে পর্তুগালের হয়ে রোনালদো ৯ ম্যাচে করেন ১০ গোল। এ বছরেই রোনালদো নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। আরেকটি করেন বিশ্বকাপের প্লে অফ ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে। যেখানে ইব্রাহিমোভিচের সঙ্গে তার একটি ভালো প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেই ম্যাচের পর রোনালদো পৌঁছান ৪৭তম গোলে।

২০১৪ সালে বিশ্বকাপে ব্রাজিলে রোনালদো পৌঁছান চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ফিফা ব্যালন ডি’অর জয়ী হিসেবে। কিন্তু ইনজুরি তাকে বেশ ভুগিয়েছে। গ্রুপপর্ব থেকেই পর্তুগাল বিদায় নেয়। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ব্যাথানাশক ওষুধ খেয়ে ঘানার বিপক্ষে খেলতে নামেন রোনালদো।

ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, ‘যদি এই দলে আর ২-৩টা রোনালদো থাকত তাহলে আমি একটু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম কিন্তু আমাদের ছিল না। আমি কখনওই ভাবিনি আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবো কারণ আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি।’

২০১৬ সালের ইউরো বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচে আলবেনিয়ার সঙ্গে পর্তুগাল যখন হেরে গেল তখন ইনজুরিতে পড়লেন রোনালদো। বেন্টোকে বদলে কোচ করা হলো ফার্নান্দো সান্তোসকে। স্পোর্টিংয়ে দুইজনের সাক্ষাতের ১১ বছর পর আবারও একসঙ্গে হলেন সান্তোস এবং রোনালদো।

সান্তোস অবশেষে পারলেন রোনালদোকে কেন্দ্র করে দলের গেমপ্ল্যান সাজাতে। সান্তোসের অধীনে প্রথম ৪টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে রোনালদো করলেন ৫ গোল। ২০০৮ সালের পর পর্তুগাল এই প্রথম বাছাইপর্বের গ্রুপে শীর্ষে থেকে সরাসরি টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ করে নেয়।

আবারও রোনালদো টুর্নামেন্টে পদার্পণ করেন চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী হিসেবে। ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোলও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৬ ইউরো কাপের শুরুটা ভালো হয়নি পর্তুগালের।

আইসল্যান্ড এবং অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে দুই ম্যাচে ২০টি শট নিয়েও গোল করতে পারেননি রোনালদো। আবার একটি পেনাল্টিও মিস করেন। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর রোনালদো বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই মিডিয়াতে বলেছিলেন, ‘তারা শুধু ডিফেন্ড ডিফেন্ড ডিফেন্ডই করে গেছে। তারা এই টুর্নামেন্টে আর কিছু করার জন্যে আসেনি।’

গ্রুপের শেষ ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে নামার আগে রোনালদো দলের সঙ্গে যখন হাঁটছিলেন তখন একজনের মাইক্রোফোন ধরে পানিতে ফেলে দেন তিনি, এতটাই মেজাজ খারাপ ছিল রোনালদোর।

হাঙ্গেরি পর্তুগালের বিপক্ষে ২-১ গোলে যখন এগিয়ে ছিল তখন পর্তুগালের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত। কিন্তু ত্রাতা হয়ে আসলেন রোনালদো। তার কল্যাণে পর্তুগাল ৩-৩ গোলে ম্যাচটি ড্র করে এবং ৩ পয়েন্ট নিয়ে কোনমতে টুর্নামেন্টের পরের রাউন্ডে জায়গা করে নেয়।

আদ্রিয়েন সিলভা ম্যাচ শেষে বলেন, ‘আপনার কিছু খেলোয়াড় রয়েছে যারা জন্ম থেকেই নেতা। রোনালদো তাদের একজন। সে মাঠে যেমন একজন যোগ্য নেতা, ড্রেসিংরুমেও ভালো নেতা। যখন খেলোয়াড়রা হোটেল ছেড়ে হালকা হাঁটার জন্য বাইরে যায় তখনও তার নেতৃত্ব চোখে পড়ে আমাদের। রোনালদো তাদের সবাইকে তাকে অনুসরণ করতে বলেন এবং সবাই তাই করে।’

আদ্রিয়েন সিলভা আরও বলেন, ‘যখন কোন দল আমাদের দলকে দেখে তখন সবসময়েই তারা একটু বেশি ভয়ে থাকে কারণ আমাদের রোনালদো আছে। এটা একদিক দিয়ে আমাদের এগিয়ে রাখে। খুব বেশি দল এই সুযোগটা পায় না।’

শেষ ষোলোর ম্যাচে রোনালদো শট তার বন্ধু কোয়ারেজমার কারণে গোল থেকে বঞ্চিত হয় কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে ঠিকই কোয়ারেজমা গোল করে দলকে কোয়ার্টারে তোলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদো ২০১২ সালের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রথম পেনাল্টিটি নিতে আসেন টাইব্রেকারে।

সেই ম্যাচেও জয় পায় পর্তুগাল। সেমিফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে হেডে গোল করে দলকে তোলেন ফাইনালে। এই গোলের সুবাদে রোনালদো ইউরো কাপের ইতিহাসে মিশেল প্লাতিনির সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলদাতার মুকুট অর্জন করেন।

কিন্তু রোনালদো ফাইনাল ম্যাচটি ছিল মাত্র ২৫ মিনিটের। দিমিত্রি পায়েটের করা ট্যাকেলে সে ইনজুরিতে পরে। মাঠেই চিকিৎসা নিলেও খেলার মত অবস্থায় ছিলেন না তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন রোনালদো। তার অনুপস্থিতিতে নানি অধিনায়কের দায়িত্ব পান। রোনালদো নানিনে আর্মব্যান্ডটি দিয়ে বলেন, ‘এটা পরো এবং ফাইনালটা জয় কর।’

রোনালদো দর্শক হয়ে থাকার পাত্র নন। ম্যাচের বাকিটা সময় টাচলাইনে দাঁড়িয়ে দলকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, দলকে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যখন সে ডাগআউটে বসে থাকত তখনও তার মনে হতো সে মাঠেই খেলে যাচ্ছে। আদ্রিয়েন সিলভা একটি সহজ সুযোগ মিস করার পর রোনালদো তাকে আরও উজ্জীবিত করে।

এডার যখন বদলি হিসেবে মাঠে নামবে তখন রোনালদো এডারকে বলছিলেন, ‘শক্ত থাকো। তুমিই জয়সূচক গোলটি করতে যাচ্ছ।’ এডার শেষপর্যন্ত সেটিই করেন। রোনালদো মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে থেকে দলকে প্রথম ট্রফি জিততে সাহায্য করেন।

ইউরো কাপ জয়ের পর রোনালদো গোল যেন গুলির মত শুধু বের হচ্ছিল। ২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে রোনালদো ১৪ গোল করেন। লেস্টারের রিকার্ডো পেরেইরা বলেন, ‘এটা আমার জন্য সম্মানের যে তার মত একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে জাতীয় দলে খেলতে পেরেছি।

একজন কিংবদন্তির সঙ্গে একই দলে থাকাটা প্রথমে আমাকে বিস্মিত করেছে। ডিনারে আমার টেবিল তার ৩-৪ টেবিলের পরেই ছিল। আমি এখনও ঘোরের ভেতর আছি যে আমি কি সত্যিই তার সঙ্গে এক টেবিলে খেয়েছিলাম!’

২০১৮ বিশ্বকাপে রোনালদো ফ্রেঙ্ক পুসকাসের ইউরোপিয়ান ফুটবলার হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভাগ বসান। ৮৪ নাম্বার গোলটিও তিনি করেন স্পেনের বিপক্ষে চোখ ধাঁধাঁনো ফ্রি কিক থেকে। পুসকাসের রেকর্ডটি তিনি ভাঙেন মরক্কোর বিপক্ষে গোল করে। তবে শেষ ষোলোতে উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নেয় তার দল।

২০১৯ সালে রোনালদো ১০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে করেছেন ১৪টি গোল। পর্তুগালের জার্সি গায়ে রোনালদোর ১৬৪ ম্যাচে বর্তমান গোলসংখ্যা ৯৯টি। শেষের ৭৬টি গোল এসেছে মাত্র ৮৮ ম্যাচ থেকে। শেষের ৪৪টি গোল শেষ ৪ বছরে! রোনালদোর সামনে এখন কেবলই আলি দাই। আলি দাই অবসর নেওয়ার ১২ বছর পর্যন্ত তার গোল সংখ্যার ২৫ গোলের ব্যবধানে কেউ ছিল না।

রোনালদো এসে সেই ব্যবধান নিয়ে এসেছেন দশে। সম্প্রতি রোনালদো বলেছেন, ‘সব রেকর্ড একদিন ভাঙবে। আমি এই রেকর্ড ভাঙবই। রেকর্ডটি দ্রুত কিংবা দেরিতে হলেও আমার কাছে আসবে।’

রোনালদো সবমিলিয়ে ৪১টি ভিন্ন দেশের বিপক্ষে গোল করেছেন। সম্প্রতি নিজের সমাধিতে কী লেখা থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে রোনালদো বলেন, ‘নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু? আমি এই নাম্বার চিনি না। আমার কাছে আমিই বিশ্বের সেরা।’

সুত্রঃ ইংলিশ ম্যাগাজিন ফোর ফোর টু

 

আরপি/ এমএএইচ-০৫



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top