রাজশাহী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

“আল্লাহ আমাগো ফারুক রে ভালা রাখুক”


প্রকাশিত:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০০:১২

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫৯

ফারুকের ‘দশে মিলে করি ভোজ’

“আমাগো বাড়ির আশে পাশে অনেক ধনী লোক আছে। হ্যাই ইচ্ছা করলে আমাগো মত মানুষ রে এক বেলা খাওয়াতে পারে। সেটা তারা করে না। কিন্তু আমাগো ফারুক প্রতি শুক্রবার দুপুরে এক বেলা খাওনের ব্যবস্থা করে। আল্লাহ আমাগো ফারুক রে অনেক ভালা রাখুক”।

এভাবেই বলছিলেন রাজশাহী নগরের কলোনি এলকার নূর জাহান বেগম (৫৫)। শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী নগরের শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান চত্বরের পাশে, গৌরহাঙ্গা গোরস্থানসংলগ্ন ফুটপাতে ‘দশে মিলে করি ভোজ’ এ কথা হয় তার সাথে।

নূর জাহান বেগম জানালেন, তিনি এক সময় রেলওয়ে স্টেশনে ডিম বিক্রি করতেন। কিন্ত করোনাকালে তার ডিম বেঁচা -কেনার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তার সংসারে চলে নানা টানাপড়েন। এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। তিনি জানতেন প্রতি শুক্রবার ফারুক কাজ না পাওয়া শ্রমিক, যাত্রী না পাওয়া রিকশাচালক, ভিক্ষুকসহ অনেক অভুক্ত মানুষকে খাওয়ান । সেই কারণে তার এই ‘দশে মিলে করি ভোজ’ এ দুপুরের খাবার সেরে নিলেন।

সহিদা বেগম (৫০) নগরে ভিক্ষা করেন। তিনি বলেন, যেখানেই যান শুক্রবার দুপুরে এই এলাকায় থাকেন। আয়েশ করে একবেলা ভালো খাবার খেতে পান। নগরে রিক্সা চালাতে এসছিলেন চারঘাটের নিজাম। তিনি বলেন, শীতে লোকজন তেমন বের হচ্ছে না। তাই রিক্সা ভাড়াও হচ্ছে না। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই এখানে এসে খেয়ে নিলেন। একই কথা বলেন রাজ পাড়া থানার মোয়াজ্জেম মোল্লা।

দুপুর বেলায় দোকানের পাশে বসে থাকেন কাজ না পাওয়া শ্রমিক, যাত্রী না পাওয়া রিকশাচালক, ভিক্ষুকসহ অনেক অভুক্ত মানুষ। তাঁদের সামনে দুপুরের খাবার খাওয়া কেমন যেন অস্বস্তিকর। রাস্তার ধারে চায়ের দোকানি একটি বালকের বহুদিন মনে হয়েছে, এদের সঙ্গে নিয়ে একত্রে খেলে ভালো হতো। কিন্তু সামর্থ্য ছিল না।

বড় হয়ে যখন সামর্থ্য হয়েছে, তখন এক নতুন প্রথা গড়ে তুলেছেন ফারুক আহম্মেদ। প্রতি শুক্রবার রাস্তার অভুক্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খান এই চায়ের দোকানি। ফারুক আহম্মেদের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে। বাবার নাম আবদুল মান্নান। তাঁরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে ফারুক সবার বড়। রাজশাহীতে খুব ছোট বেলায় চলে আসেন।কোনো উপায় না দেখে ফুটপাতে চায়ের দোকান দিয়ে বসেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি একই জায়গায় চায়ের দোকান চালাচ্ছেন।

২০১৬ সালে শুরুতে ১৫-১৬ জনকে নিয়ে খেতেন। এখন সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দুই শতাধিক। আগে পুরোটাই খরচ করতেন নিজের পকেট থেকে। এমন উদ্যোগ দেখে কিছু মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে।

একজন চা– দোকানির এই উদ্যোগ দেখে মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাঁর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্লেট কিনে দিয়েছেন। একটি বড় হাঁড়ি তিনি নিজে কিনেছেন ৪ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে। আরেকটি একজন দান করেছেন। তবে যাঁরা দান করেন, তাঁরা নিজের পরিচয় দিতে চান না।

ফারুক আহম্মেদ বলেন, প্রতি শুক্রবারেই অভুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, যা তাঁর একার পক্ষে সংস্থান করা সম্ভব হয় না। তাই কেউ সহযোগিতা করলে তিনি ফিরিয়ে দেন না। মানুষের সহযোগিতা পেয়ে তিনি খাবারের মানোন্নয়ন করেছেন। প্রথমে দুই কেজি চালের সবজি-খিচুড়ি করতেন। এখন করেন বিরিয়ানি। আগে দুই কেজি চালের খিচুড়ি করতেন। এখন দুই হাঁড়িতে করেন ৫০ কেজি চাল দিয়ে। আগে মাংস দিতে পারতেন না। এখন মাংস দেন। করোনাকালে দুই মাস বন্ধ রেখেছিলেন। পরে রমজানের ১০ তারিখ থেকে ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে আবারও শুরু করেন তিনি। দিনে দিনে লোক সংখ্যা বাড়ছে।

রান্নার এই বিশাল আয়োজনের জন্য ফারুক আহম্মেদের পরিবারের লোকজনও সহযোগিতা করে থাকে। ছেলে মেহেদী বরেন্দ্র কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। শুক্রবার তার ছুটির দিন হওয়ার কারণে সে এসে বাবার চায়ের দোকান দেখা শুনা করছে। বাাবা ফারুক তার পুরো সময়টুকু রান্নার কাজে ব্যয় করছেন। ফারুক বৃহস্পতিবারের দিন বাজার করেন। স্ত্রী পলি খাতুনসহ দুই মেয়ে কাটা-বাছার কাজ করে দেন।

আজ (০৫ ফেব্রুয়ারি) শুক্রবার দুপুরে তাঁর চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, বিরাট হাঁড়িতে রান্না চলছে। পাশেই থালা বাসন পরিষ্কার করছেন সানু বেগম (৪০)। তিনি নগরের পরিচ্ছন্ন কর্মী। প্রতি শুক্রবার ফারুকের এমন কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। সেই সাথে পাশে দেখা যায়, রান্নার কাজে সহযোগিতা করছেন রফিকুল ইসলাম, নাদিম শেখ এবং আবু জাফর নামের নামের এক যুবক। প্রতি শুক্রবার দুপুরে ছিন্নমূল ও অভুক্ত মানুষকে খাওয়াতে ফারুকের এমন কাজে সহযোগিতা করেন তারা। 

 

আরপি / এমবি-১

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top