রাজশাহী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঘায় স্বর্ণালী মুকুলে দোল খাচ্ছে আমচাষীদের স্বপ্ন


প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০২:৩৯

আপডেট:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৩:২৬

স্বর্ণালী র্মুকুল

শীতের স্নিগ্ধতার মধ্যেই শোভা ছড়াচ্ছে স্বর্ণালী আমের মুকুল । উঁকি দিচ্ছে গাছে গাছে আমের মুকুল। আবার দেখা মিলছে কিছু গাছের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা আমের মুকুল। কিন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় টের পাওয়া যায় ধীরে ধীরে নিজেকে লুকিয়ে নিচ্ছে থোকায় ধরা আমের সেই মুকুল।

এবার নির্ধারিত সময়ের আগেই আবহাওয়াগত ও জাতের কারণেই মাঘের শুরুতেই অনেক আম গাছে আমের মুকুল আসতে শুরু করেছে। পৌষের শেষেই আগাম মুকুল দেখে আমচাষীদের মনেও আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠেছে। সদ্য মুকুল ফোঁটার এ দৃশ্য ছেয়ে যেতে শুরু করেছে রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে। বাতাসে মিশে আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণে এরই মধ্যে মৌ মৌ করতে শুরু করছে চারিদিক।

বনফুল থেকে মৌমাছির দল গুনগুন করে ভিড়তে শুরু করেছে আম্র মুকুলে। গাছের কচি শাখা-প্রশাখায় ফোটা স্বর্ণালি ফুলগুলোর উপরে সূর্যচ্ছটা পড়তেই চিকচিক করে উঠছে। এজন্য মাঘের হিমেল হাওয়ায় সবুজ পাতার ফাঁকে দোল খাওয়া স্বর্ণালি মুকুলের সুমিষ্ট সুবাস আনন্দে ভরে উঠছে চাষীর মন। পরিবেশ ও প্রতিবেশ জানান দিচ্ছে আসছে আম উৎসবের। মধুমাসের আগমনী বার্তা শোনাচ্ছে আমের মুকুল।

রাজশাহীর আমের রাজধানীখ্যাত বাঘা ও চারঘাট উপজেলার গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে মুকুল। সোনারাঙা সেই মুকুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে বাতাসে। তাই এই মুকুল টিকে থাকলে এবারও আমের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন আম চাষীরা। তারা মনে করছেন, বাঘা-চারঘাটে বিভিন্ন জাতের আম নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এবার বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে ।

তাই আগামীর সম্ভাবনায় স্বপ্ন নিয়ে বাগান পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন আম চাষীরা। চলতে-ফিরতে কমবেশি সব শ্রেণীর মানুষেরও নজর এখন চির সবুজ আমগাছের মগডালে।

এলাকার আমবাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, আগাম মুকুল ফুটেছে বিভিন্ন বাগানের আম গাছে । চলতি আম মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে আমের ফলন গত বছরের চেয়ে ছাড়িয়ে যেতে পারে। রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলাসহ আশে পাশের উপজেলা হতে উৎপাদিত সুমিষ্ট আম্রপালি, বারী-৪, হিমসাগর আম দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে বলে মনে করছেন আম চাষিরা ।

রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় আড়ইশ’ জাতের সুস্বাদু ও রসালো মিষ্টি আমের ফলন হয়। তবে এবারও জাত আম খ্যাত গোপালভোগ ও ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লকনা এবং মোহনভোগ আমই বেশি চাষ হয়েছে।

পাকুড়িয়া এলাকার আম চাষী শফিকুল ইসলাম ছানা বলেন, মুকুল যাতে ঝরে না পড়ে সে জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতা ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, এই আম বিক্রি করেই অনেক চাষী মেয়ের বিয়ে দেন, নিজের চিকিৎসা খরচ জোগাড় করেন, বড় ঋণ পরিশোধ করেন, মহাজনের কাছ থেকে টাকা দিয়ে জমি ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এছাড়াও ভালো জাতের আম বিদেশে রপ্তানি করেন। আয় বাড়ে শ্রমিক থেকে শুরু করে আমের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

তাই গাছ, মুকুল আর আম অনেকেরই বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। তুৃলশিপুর গ্রামের আম ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান জানান, আমের মুকুল, কৃষক ও ব্যবসায়ীর স্বপ্ন একই সুতোয় গাঁথা। তাই আম প্রধান এই অঞ্চলের মানুষের বছরের প্রায় পুরোটা সময় কাটে আম গাছের পরিচর্যা ও মুকুলের যত্নআত্তি নিয়েই। তিনি বলেন, সাধারণত মাঘের শেষে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমের মুকুল আসে। এবার প্রায় এক মাস আগে মধ্য জানুয়ারিতেই কিছু কিছু গাছে আমের আগাম মুকুল চলে এসেছে। এখন ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া না হলেই ভালো হয়।

এদিকে, আগাম মুকুলে আমচাষীরা খুশি হলেও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, টানা শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে মাঘ মাসজুড়ে যদি আবার ঘনকুয়াশাও স্থায়ী হয় তাহলে আগে ভাগে গাছে আসা মুকুল ক্ষতিগ্রন্ত হবে । তবে আমের মুকুল আসার ৭-১০ দিনের মধ্যে অথবা মুকুলের দৈর্ঘ্য ১ থেকে দেড় ইঞ্চি হলে (অবশ্যই ফুল ফুটে যাবার আগে) আমের হপার পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড (ইমিটাফ, টিডো, কনফিডর) ৭০ ডব্লিউ জি বা অন্য নামের অনুমোদিত কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে অথবা সাইপারমেথ্রিন (রেলোথ্রিন, কট, রিপকর্ড) ১০ ইসি বা অন্য নামের অনুমোদিত কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে বা অন্যান্য অনুমোদিত কীটনাশক এবং এথ্রাকনোজ রোগ দমনের জন্য ম্যানকোজেব (ইন্ডোফিল, ডাইথেন, কম্প্যানিয়ন ) এম-৪৫ নামক বা অন্যান্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে একত্রে মিশিয়ে আম গাছের মুকুল, পাতা, শাখা প্রশাখা ও কান্ডে ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

এরপর ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যে আম মটরদানা আকৃতির হলে একই ধরনের কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক উল্লিখিত মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে মুকুল পাতা ও কান্ড ও শাখা প্রশাখা ভিজিয়ে আর একবার স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর।

বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শফিউল্লাহ সুলতান জানান, গতবছর এই উপজেলায় ৮ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার আম চাষ করা হয়েছিল। গত মৌসুমে আমের বাজার দর ভালো থাকায় লাভবান হয়েছিলেন চাষীরা। যার কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছর ১০০ হেক্টর জমিতে আম বাগান বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নতুন বাগানে এবার আম আসবে না। গত বছর ৯০ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছিল।

এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৫লক্ষ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পাবে। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলীম উদ্দিন বলেন, প্রতি বছরই কিছু আমগাছে আগাম মুকুল আসে। এবারও আসতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশার কবলে না পড়লে এসব গাছে আগাম ফলন পাওয়া যায়। এখন যদি ঘন কুয়াশা পড়ে এবং তা যদি স্থায়ী হয়, তাহলে পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব মুকুলের অধিকাংশই ঝরে যাবে। ফলে বাগান মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যা ফলনেও প্রভাব ফেলবে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, আবহাওয়া যদি রৌদ্রজ্জ্বল হয় এবং তাপমাত্রা একটু বাড়ে তবে সমস্যা হবে হবে না। আর মুকুলগুলো প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে পড়লে ফলন খারাপ হবে। তবে নিয়ম মেনে শেষ মাঘে যেসব গাছে মুকুল আসবে সেসব গাছে মুকুল স্থায়ী হবে। তাই শেষ পর্যন্ত না দেখে বলা খুবই কঠিন যে, কি হবে।

আরপি / এমবি-১৪



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top