রাজশাহী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


শিক্ষার্থীদের হাতে কবরের কঙ্কাল


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৪৬

আপডেট:
৩০ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৪৭

ছবি: সংগৃহীত

মেডিক্যালের পড়াশোনায় কঙ্কালের ব্যবহার থাকলেও সরবরাহের কোনও নীতিমালা নেই দেশে। শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হয় কৃত্রিম কঙ্কালের ওপর। তবে অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষকরা মনে করেন, আসল কঙ্কালের মতো করে কৃত্রিম কঙ্কাল বানানো সম্ভব নয়। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কবর থেকে চুরি করা কঙ্কাল নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে একটি চক্র।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের আর কে মিশন রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১২টি মাথার খুলি ও দুই বস্তা মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্ধার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ সময় দুই কন্টেইনার তরল কেমিক্যাল ও তিন প্যাকেট রাসায়নিকসহ বাপ্পি (২৫) নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়।
কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার বলেন, চক্রটি বছরে তিনবার কবর থেকে কঙ্কাল উঠায়। প্রতিবার ২০/২৫টা কঙ্কাল দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজসহ বিদেশে পাচার করে। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়া এলাকা ও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তারা ভারত ও নেপালে কঙ্কাল পাচার করে। ২০১৭ সালে বেনাপোল দিয়ে পার করার সময় ১৫টি কঙ্কাল নিয়ে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল বাপ্পি। কঙ্কালের রমরমা বাণিজ্যের লোভে জেল থেকে ফিরে আবারও ব্যবসায় নেমে পড়ে।

ওসি জানান, কবর খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে জড়িতদের মাধ্যমে খবর চলে যায় বাপ্পির কাছে। তারা প্রথমে কবর থেকে লাশ তুলে নির্জন স্থানে রাসায়নিক ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কঙ্কাল আলাদা করে। পরে তুলে দেয় পাচারকারীর হাতে। তাদের মাধ্যমে এই কঙ্কাল চলে যায় মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এবং পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতে।

কারা জড়িত?

পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, দেশে কঙ্কাল ব্যবসার মূল হোতাদের একজন এই বাপ্পি। তার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই কর্মচারীরা শিক্ষার্থীদের কাছে কঙ্কালের চাহিদা পাওয়ার পর এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে চড়া দামে তাদের হাতে কঙ্কাল পৌঁছে দেয়।
ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আহমারউজ্জামান বলেন, আটককৃত ব্যক্তির জবানবন্দি অনুযায়ী কঙ্কাল চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্পষ্ট কিছু বলা যাবে না।

কঙ্কালের চাহিদা

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আঞ্জুমান বানু জানান, অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য কঙ্কালের প্রয়োজন হয়। কিছু পড়াশোনা আছে, যা কঙ্কাল ছাড়া সম্ভব নয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে কঙ্কাল থাকলে ভালো। কঙ্কাল কেনাবেচার ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনও বিধিমালা না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা যে যেভাবে পারে কঙ্কাল সংগ্রহ করছে।
একই মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, তিন বছর আগে তিনি যখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তখন একটি মানবকঙ্কাল সংগ্রহ করতে তাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। পরে অনেককে ধরে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একজন দালালের মাধ্যমে আসল কঙ্কাল সংগ্রহ করেন।

কঙ্কালের দাম ও নীতিমালা

ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করে পাচারকারীরা। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, একটা আস্ত কঙ্কাল কিনতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ পড়ে। কৃত্রিম কঙ্কাল শিক্ষার্থীরা ১৫-২০ হাজার টাকা দিয়ে সংগ্রহ করে। এই চিকিৎসক বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পর থেকে কঙ্কাল আর লাগে না। তখন আবার অনেকে বিক্রি করে দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিক্যাল শিক্ষা বিষয়ক ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবু সালেহ মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের জন্য কঙ্কাল ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ কিংবা শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের কোনও নীতিমালা নেই।

কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয় কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেসব মরদেহের কোনও পরিচয় থাকে না বা কেউ দাবি করে না, সেগুলো সরকার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য দিয়ে দেয়। তবে এর কোনও লিখিত নিয়ম নেই। আবার অনেকে মারা যাওয়ার আগে নিজের মরদেহ দান করে থাকেন।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, আমার জানামতে দুটি দান করা কঙ্কাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আছে। এমন দানের সংখ্যা খুব কম। কঙ্কাল বেচাকেনার কোনও নীতিমালা না থাকায় কঙ্কাল নিয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ পায় পাচারকারী চক্র। তবে আমি মনে করি, খুঁজলে ভালো মানের কৃত্রিম কঙ্কাল পাওয়া যাবে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে কবর খুঁড়ে লাশ বা কঙ্কাল চুরি চরম অনৈতিক কাজ বলে গণ্য হলেও প্রচলিত আইনে এর শাস্তির স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অপরাধী ধরা পড়লেও পার পেয়ে যায়। তবে পুলিশ বলছে, কবর থেকে কঙ্কাল চুরি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।

 

আরপি/টিএস-০৩



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top