বিসিএসের জন্য নিত ৪৫ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা, পিএসসি কর্মকর্তারা
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ঠিক কতজন প্রশ্নপত্র ফাঁসকাণ্ডে জড়িত, এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে এ পর্যন্ত চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে শতকোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সিআইডির ভাষ্য, প্রশ্ন ফাঁসের এই চক্রে শতাধিক দুর্নীতিবাজ জড়িত।এর মধ্যে পিএসসির অন্তত ১৬ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গাড়িচালক আবেদ আলীসহ চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরো ১০ জন নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে। তথ্য যাচাই করে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকলে তাঁদেরও পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
সিআইডি বলছে, ২০০২ সাল থেকে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কেউ না কেউ জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
সেসব মামলায় কারা আসামি ছিলেন, কার কার বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ আনা হয়, কে কত টাকার মালিক হয়েছেন, কে কে জামিনে রয়েছেন, ব্যাংকে কার কত টাকা আছে, তাঁরা কত টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন, তাঁরা বিদেশে কত টাকা পাচার করছেন—এমন সব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এসব তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম ও আবু জাফর এবং সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির ও সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়সহ আরো অন্তত অনেক কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত ছয় কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে নিখিল চন্দ্র এখনো গ্রেপ্তার হননি।
এ ছাড়া পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, অফিস সহায়ক ডন কুমার, গাড়িচালক আতাউর রহমানসহ আরো ১০ জনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় তাঁদের বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্য যাচাই করছে সিআইডি।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীসহ ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৪ সালে তিনি চাকরি হারান। তবে পিএসসি থেকে চাকরি চলে গেলেও আবেদ আলীর প্রশ্ন ফাঁসের কার্যক্রম থেমে থাকেনি। তিনি এই সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং তাঁর ছেলেকেও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত করেন। তদন্তে এরই মধ্যে আবেদ আলীর বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর বাইরে ফরিদপুরে সরকারি জমি দখল করে পশুর খামার করার তথ্য পাওয়া গেছে।
পিএসসির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। এ তথ্য জানিয়ে সিআইডি সূত্র বলেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গত সোমবার রাতে ৩১ জনের নামে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে এ বিষয়ে মামলা করা হয়। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন অভিযুক্ত পলাতক রয়েছেন। এই কর্মকর্তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পিএসসির ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহকারী সাজেদুল ইসলামের মাধ্যমে আবেদ আলীর হাতে তুলে দিতেন বলে জানায় সিআইডি।
সূত্র বলছে, তাঁদের মধ্যে অনেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক এলাকায় জায়গা এবং দামি গাড়ির মালিক হয়েছেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, গত তিন মাসে এই সিন্ডিকেট সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সহায়তায় সিআইডি ১৭ আসামির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি জব্দ করেছে।
এ বিষয়ে সিআইডির সাইবার তদন্ত ও অপারেশনের বিশেষ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, গ্রেপ্তার ১৭ জন গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আরো বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গেও এই চক্রের সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হোয়াটসআপ কথোপকথন থেকে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় অর্থ লেনদেনের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিআইডি। সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার ১৭ জন দুটি গ্রুপে কাজ করতেন। চুক্তি অনুযায়ী একজন প্রার্থীর কাছে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে তাঁরা এক থেকে দুই লাখ টাকা নিতেন। একইভাবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আগে এক থেকে দুই লাখ টাকা দিতে হতো। নিয়োগ চূড়ান্ত হয়ে গেলে দিতে হতো বাকি টাকা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতেন তাঁরা। আর বিসিএসের জন্য চুক্তি হতো ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকায়। এভাবে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা এ পর্যন্ত শতকোটি টাকার বেশি লেনদেন করার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি সূত্র।
এ ছাড়া মিলেছে বেশ কিছু ডিজিটাল আলামত। তাঁদের কাছ থেকে দুটি বিসিএস পরীক্ষার শত শত প্রবেশপত্রের ফটোকপি পাওয়া গেছে। তবে কোন দুটি বিসিএস পরীক্ষার প্রবেশপত্র—এ বিষয়ে কিছু জানায়নি সিআইডি।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি খুবই শক্তভাবে দেখছেন তাঁরা। সিআইডি বিষয়টির ওপর স্পেশাল ফোকাস দিয়েছে।
সুনির্দিষ্টভাবে নাম এলে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কি না জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গাড়িচালক আবেদ আলীর বিষয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, সে (পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী) একটি দলের ষড়যন্ত্রের ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সে তো একটি দলের হয়ে কাজ করছে, সরকারের ইমেজ নষ্ট করার জন্য। অনেক দিন আগে এমন কাজের কারণে সে চাকরিচ্যুত হয়েছে।
বিপিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় করা মামলায় ছয়জনকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে সিআইডি। তাঁদের মধ্যে পিএসসির উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমও রয়েছেন। গতকাল এই আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত আসামিদের উপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানির জন্য ১৬ জুলাই তারিখ ধার্য করেছেন। অর্থ লেনদেনসহ তাঁরা কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস করেন—এমন ৯টি বিষয়ে তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে এই আবেদনে জানানো হয়।
অন্য পাঁচ আসামি হলেন পিএসসির সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, ডিডি আবু জাফর, প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগ এসিসিডিএফের (বিওএফ) অডিটর প্রিয়নাথ রায়, মিরপুরের পোশাক কারখানার ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী এবং ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম।
আরপি/জেডএফ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: