রাজশাহী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


মিল্টন সমাদ্দার যেভাবে হয়েছিলেন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’


প্রকাশিত:
৬ মে ২০২৪ ২০:১৭

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ১০:৩১

 ছবি:সংগৃহিত

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার (৪২) ভয়ংকর প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এরপর থেকেই মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে।

মিল্টন সমাদ্দারের শুরুটা আন্তঃনগর বাসের হেল্পার হিসেবে। সেখান থেকে তিনি দাতব্য অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন। বিলাসবহুল গাড়ি, জমির মালিক হওয়ার পাশাপাশি সমাজসেবী হিসেবে হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।
ফেসবুকে ১৬ মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার নিয়ে বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন মিল্টন। তার মানবিক কাজকর্মের জন্য প্রশংসা কুড়ান। তবে এখন তিনি আলোচনায় অন্য কারণে। গত ১ মে মিল্টনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। মিল্টনের বিরুদ্ধে তার দাতব্য সংস্থা চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৮৩৫ জন ব্যক্তির মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে আনা হয়েছে।

এছাড়া মানব পাচারের অভিযোগও রয়েছে মিল্টনের বিরুদ্ধে। যার ফলে গতকাল ঢাকার একটি আদালত নতুন করে তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগে তিন দিনের রিমান্ড শেষে গোয়েন্দারা তাকে আদালতে হাজির করলে ঢাকা মহানগর হাকিম শান্তা আক্তার এ আদেশ দেন।

মিল্টন সমাদ্দারের জন্ম বরিশালের একটি গ্রামে। পরে মিরপুরের একটি ফার্মেসিতে বিক্রয়কর্মীর কাজ করতেন। এরপর ২০১৩ সালে মিরপুরে শিশু ও বয়স্কদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে প্রশংসা ও সম্পদের দেখা পান মিল্টন। মানবিক কাজের জন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।

তবে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলোতে মিল্টনের কার্যকলাপের অন্যরকম চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণ মানুষের দান করা তহবিলের অপব্যবহার, তার তত্ত্বাবধানে থাকা মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং তার দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে অবৈধভাবে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে মিল্টনের বিরুদ্ধে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে চিকিৎসার আড়ালে মিল্টনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারে জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মিল্টন সমাদ্দারের পরিচিত স্থানীয় একটি মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেনের একটি অভিযোগে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।

তোফাজ্জল বলেন, মিল্টনের আশ্রমে মারা যাওয়া কিছু ব্যক্তির মরদেহ গোসল করানোর সময় দেখা যায়, সবগুলোর শরীরে কাটা দাগ। এর জেরে আশপাশের স্থানীয় মসজিদে তার আশ্রমের মরদেহ দাফনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।

দাতব্য তহবিলের অপব্যবহার: মিল্টনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে একটি সাততলা আশ্রম নির্মাণ। এর জন্য তিনি বড় অঙ্কের অনুদান ও জনসমর্থন পেয়েছিলেন।

সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মন্ডল জানান, ১৮ মাস ধরে প্রায় ৪৫.৪০ জমিজুড়ে নতুন আশ্রম নির্মাণের কাজ চলছে। মার্চ মাসে এর উদ্বোধন হয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, আশ্রমটি নির্মাণের জন্য সম্ভবত বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন হয়েছিল।

নিকটবর্তী বাসিন্দা শামসুদ্দিন চৌধুরী জানান, নতুন আশ্রমের পাশে তার জমি আছে। শামসুদ্দিন দাবি করেন, মিল্টন ও তার সহযোগীরা পার্শ্ববর্তী রাস্তা দখল করেন এবং ১০ এপ্রিল তাকে হুমকি দেন। এর ফলে ১৫ এপ্রিল তিনি সাভার থানায় মামলা করেন।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যমতে, মিল্টনের দুটি পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখনও ১.২৫ কোটি টাকা রয়েছে। এ তথ্যে দাতব্য কাজের জন্য আসা অনুদান কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়।

গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন মিল্টন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে দাতব্য তহবিলের অর্থে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে আরও অনুদান আনার জন্য কবরের সংখ্যা বাড়িয়ে বলতেন।

শুরু থেকেই প্রতারক: মিল্টন বড় হয়েছেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নে। তার বড় ভাই লিটন সমাদ্দার বর্তমানে গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। ফলে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মিল্টনের বাবা জন সমাদ্দার অনেক আগেই মারা গেছেন। পুলিশের তথ্য অনুসারে, নিজের বাবাকে মারধর করেছিলেন মিল্টন। সেই ঘটনার জেরে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয় এলাকাবাসী। এরপর তিনি শহরে চলে যান।

মিল্টন কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকার শাহবাগ এলাকার একটি ফার্মেসিতে। কিন্তু চুরির অভিযোগে সেই চাকরি হারান। পরে তিনি একজন নার্সকে বিয়ে করেন এবং শিশু ও বয়স্কদের সেবার জন্য একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

এখন মিল্টনের আশ্রম সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার কাজ ও খ্যাতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। গুঠিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য স্বপন হালদার গ্রেফতার হওয়ার আগে মিল্টনের বিরুদ্ধে আনা অপকর্মের অভিযোগগুলো

সম্পর্কে অবগত ছিলেন না জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।

এদিকে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় চার্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে মিল্টনের বিরোধ ছিল।

স্থানীয়রা বলেন, ২০২০ সালে কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া আদেশ তৈরি করেন মিল্টন।

 

 

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top