রাজশাহী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম থেকে রাজাকারদের তালিকা উধাও


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:৫৯

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:২৩

ছবি: সংগৃহীত

রাজাকারদের তালিকা প্রথম পর্যায় প্রকাশ করা হয়েছে রবিবার। এ তালিকায় রয়েছে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে আগামী ২০২০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে।

তবে তালিকাটি সম্পূর্ণ করতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। এর একটি বড় কারণ, দেশের প্রথম পর্যায়ের ১৯টি জেলায় স্বাদীনতার পর পর রাজাকারের তালিকা তৈরি করা হলেও এখন তা অনেক জেলা থেকেই পাচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিজয় অর্জনের আটচল্লিশ বছর পর জেলা প্রশাসনগুলোর রেকর্ড রুম ঘেঁটে সেই দলিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী এখনও বিশ্বাস করেন বিভিন্ন জেলার রেকর্ড রুমে জেলাভিত্তিক তালিকাটি কোনও না কোনও ফরম্যাটে এখনও আছে।

তাই সেটি খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি বিকল্প উপায়ের সন্ধানেও নেমেছেন তিনিসহ তার মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, রাজাকারের তালিকা চূড়ান্ত করতে কিছু কৌশল বা পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। এর একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে সব জেলা প্রশাসক, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্বরত মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের ব্যক্তিগত আগ্রহেই মন্ত্রণালয় থেকে একাত্তরের রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রথম পর্বের ১০ হাজার ৭৮৯ জন তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

এই তালিকা চূড়ান্ত করতে নতুনভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালের ১৯টি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে রাজাকারদের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে শতভাগ সফল হয়নি সরকার।

বেশিরভাগ জেলা প্রশাসক তাদের জেলার রেকর্ড রুমে রাজাকারদের নামের তালিকা পাননি।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর একটা দীর্ঘ সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশ পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিল।

তারা অত্যন্ত সুকৌশলে এই তালিকা সরিয়ে ফেলেছে বলেই জেলা প্রশাসনগুলোর রেকর্ড রুমে এই তালিকা পাওয়া যায়নি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানে ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণা করে তাদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ নানা ধরনের নির্যাতনে হানাদার পাকিস্তানবাহিনীর সঙ্গী হিসেবে কাজ করেছে তারাই রাজাকার হিসেবে পরিচিত।

পাকিস্তান সরকার বাঙালি নিধনে আলবদর ও আলশামস বাহিনীও গঠন করে। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ওলামাসহ পাকিস্তানের সমর্থক অনেক দলের নেতাকর্মীরা রাজাকারসহ অন্যান্য বাহিনীতে যোগ দেয়।

রাজাকারের সংখ্যা কতো এই তথ্য এখনও অনির্ধারিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমরাধিনায়ক একে নিয়াজি তার লেখা বইয়ে লিখেছেন, রাজাকার বাহিনীতে তারা ৫০ হাজার সদস্য নিয়োগ করেছিলেন।

যাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। সেই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অন্তত ৫০ হাজার রাজাকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় সক্রিয় ছিল।

সূত্র জানায়, বিজয়ের উনপঞ্চাশ বছর পর এই ৫০ হাজার বা তারও বেশি রাজাকারকে চিহ্নিত করা সহজ কাজ নয়।

তবে যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই মুক্তিবাহিনীসহ সারাদেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তাদের নাম পরিচয় জানতো এবং তাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন তাই কঠিন হলেও এ তালিকা তৈরি অসম্ভব নয়।

বিশেষ করে স্বাধীনতা লাভের পর পর দেশের প্রথম ২০টি জেলার ১৯টিতে রাজাকারদের এই তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং একটি করে তালিকা প্রতিটি জেলায় তৈরি করাও হয়।

তবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সে তালিকা ধরে রাজাকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ আর এগোয়নি।

দফায় দফায় সামরিক শাসন আর উর্দি খুলে দল বানানোর রাজনীতিতে সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

ফলে রাজাকার হিসেবে যাদের ঘৃণিত হওয়ার কথা, সময়ের ফেরে এমন চিহ্নিত অনেকেই এসব সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে নিজেদের কুকর্ম ঢেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে চলাফেরার সুযোগও পেয়েছে।

মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও সংসদ সদস্য বা স্থানীয় রাজনীতিতে দল বদলে মিশে যাওয়া রাজাকার, আলবদরদের সংখ্যাও কম নয়।

পরবর্তীতে জোট সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী সরকারের অংশই হয়ে যায়।

ফলে প্রভাব বিস্তার করে রাজাকারের তালিকায় যাদের নাম ছিল তারা বা তাদের স্বজন ও সুবিধাবাদীরা জেলা প্রশাসনগুলো থেকে তালিকাটি সরানোর বা নিজেদের নাম বাদ দেওয়ার নানা চেষ্টা করেছে ৭৫ পরবর্তী দুই দশকের বেশি সময় ধরে।

তবে এ তালিকার একটি বড় অংশ সরকারি মুদ্রণালয় বিজি প্রেসে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজাকারের তালিকা প্রকাশের অন্যতম প্রধান সূত্রও এটি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল। তারা খুবই চতুর।

তাই জেলার রেকর্ড রুম থেকে এসব ডক্যুমেন্টস সুকৌশলে সরিয়ে নিয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেভাবেই হোক এসব তালিকা রেকর্ড রুম থেকে খুঁজে বের করতেই হবে।

কোন না কোনও ফরম্যাটে এই তালিকা এখনও সেখানে আছে বলে বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।

জানা গেছে, রাজকারদের তালিকা চূড়ান্ত করতে সরকারি অর্থাৎ বিজি প্রেসে এ সংক্রান্ত যেসব গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো সংগ্রহ করবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওই তালিকা দেখেই চূড়ান্ত করা হবে রাজাকারদের নামের তালিকা।

একাত্তরের রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে যারা ভাতা নিয়েছে বা যাদের নামে অস্ত্র এসেছে, তাদের নাম-পরিচয়, ভূমিকাসহ তথ্যাদি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল। সেগুলোই সংগ্রহের জন্য ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচন দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।

সেই উপনির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছিল সঙ্গত কারণেই তাদের অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।

ফলে তাদের নামও রাজাকারের তালিকায় যুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এজন্য জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে থেকে ওই তালিকা চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

পাওয়া গেলে রাজাকারদের তালিকায় তাদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তথ্যানুযায়ী, একাত্তরের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করতে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।

দেশের দক্ষিনাঞ্চলের খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থী কর্মী নিয়ে প্রথম গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী।

পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও গড়ে তোলা হয় রাজাকার বাহিনী। শুরুতে রাজাকার বাহিনীকে এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন রাখা হলেও একাত্তরের ১ জুন পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন।

তবে এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্থানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারি করা এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়।

এর সংখ্যা ছিল অন্তত ৫০ হাজার। তাদের চিহ্নিত করার চ্যালেঞ্জ এখন সরকারের।

 

 

আরপি/ এমএএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top