রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


সড়ক আইন বাস্তবায়নে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমবে


প্রকাশিত:
২৪ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৫২

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৫১

ইলিয়াস কাঞ্চন

ছিলেন রূপালি পর্দার জনপ্রিয় নায়ক। একের পর এক উপহার দিয়েছেন ব্যবসাসফল ছবি। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমূল বদলে দেয় তার জীবন, পেশা আর নেশাকে। রূপালি জগত ছেড়ে পা রাখেন মাটির দুনিয়ায়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেখানেও হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের সফল এক নায়ক।

টানা ২৬ বছর ধরে পরিবহন মাফিয়াদের হুমকি উপেক্ষা করে একাই আন্দোলন করে চলেছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া মানুষটি হচ্ছেন দেশবাসীর অতি প্রিয় নায়ক- ইলিয়াস কাঞ্চন।

নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ নিয়ে বাংলানিউজের একটি সাক্ষাৎকার সরাসরি তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ নিয়ে বাংলানিউজকে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তুলে ধরেন নতুন সড়ক আইন নিয়ে নিজের মতামত। বাংলানিউজের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নেন- স্টাফ করেসপন্ডেন্ট রেজাউল করিম রাজা। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: কী কী কারণে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে বলে আপনি মনে করেন?

ইলিয়াস কাঞ্চন: প্রতি বছর সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করে জাতিসংঘ। এটি ঘিরে প্রত্যেকবারই তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্বাচন করে। এর একটি ছিল- ‘কিল স্পিড, নট লাইফ’। তারা বলেছিল, তুমি গতিকে হত্যা করো, জীবনকে নয়।

জাতিসংঘ গতি কী, গতির শক্তি, গতি কতোটা ভয়াবহ ও বিপজ্জনক তা বোঝাতে বলেছিল, ২০ জন লোক একসঙ্গে ২০টি পিস্তল দিয়ে গুলি করলে যেমন বিপদ হতে পারে, ৬০ কিলোমিটার বেগে একটি গাড়ি চললে, তার চেয়েও বেশি বিপদ হতে পারে। সেই গতিকে যদি কন্ট্রোল করা না যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে, মানুষও মারা যেতেই থাকবে। আমাদের দেশের চালকদের গতি সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণা নেই। তাই সড়কে দুর্ঘটনাও ঘটে বেশি।

বাংলানিউজ: আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের সচেতনতা কতটা জরুরি?

ইলিয়াস কাঞ্চন: আমরা ১১১ দফা সুপারিশমালা তৈরি করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নতুন সড়ক আইন ও পাশাপাশি এই সুপারিশমালা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্ঘটনা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যাবে। সড়কে অনিয়ম কম হবে।ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: শাকিল আহমেদ আমাদের ১১১ দফা সুপারিশমালার মধ্যে অটোরিকশা, ইজি বাইকসহ ছোট গাড়িগুলোর বিষয়ে রাস্তার পাশে আলাদা সার্ভিস লেন করে দেওয়ার প্রস্তাবনা আছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে এটা করা শুরু হয়েছে। প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সার্ভিস লেন এডিপির অর্থায়নে পাশ হয়ে গেছে। সিলেট মহাসড়কেও রাস্তার দু'পাশে সার্ভিস লেন থাকবে। ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়কেও সার্ভিস লেন করার পরিকল্পনা আছে।

পরিবহন সেক্টরের নেতারা নতুন আইনটির বিষয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঠিকভাবে বোঝাচ্ছেন না। ৪২ লাখ পরিবহনের মধ্যে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার লাখ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান রয়েছে। তারাই এই আইনের বিরোধিতা করছে। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক শ্রমিক ছাড়া অন্য কেউতো বিরোধিতা করছে না। এমনকি এবারই প্রথম পথচারীদেরও জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে। তারা তো এই আইনের বিরোধিতা করছে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবশ্যই আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

বাংলানিউজ: সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সম্বন্ধে পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ- জরিমানার পরিমাণ অনেক বেশি করা হয়েছে। তাদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

ইলিয়াস কাঞ্চন: পরিবহন শ্রমিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের ভুল বোঝাচ্ছেন। জরিমানা দেওয়া বা করা এই আইনের উদ্দেশ্য না। আইন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- আইনটা মেনে চলা। জরিমানার পরিমাণ যদি এমন হয়- সারাদিন আমি যা আয় করলাম, তার থেকে খুব সামান্য একটা অংশ জরিমানা দিলাম, তাহলে তো বারবার আইন অমান্য করে জরিমানা দিতে কোনো অসুবিধা হবে না তাদের। জরিমানার পরিমাণ বেশি হলে নিজের টাকার মায়ায় হলেও তারা আইন মেনে চলবে।

বাংলানিউজ: সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে মামলা দায়ের, মামলার বিচার, এরপর আপিল ও রিভিউ মিলিয়ে অনেক সময় ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো আদালতের প্রয়োজন আছে কী?

ইলিয়াস কাঞ্চন: মামলার দীর্ঘসূত্রতা হওয়ার কারণ হচ্ছে- চালক যখন জামিনযোগ্য থাকে, তখন সে পালিয়ে বেড়ায়। অনেকগুলো নোটিশ পাওয়ার পরও সে হাজির হয় না। এরপর যখন তার বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট হয়, তখন আদালতে এসে একজন আইনজীবীর সহায়তায় সময়ের আবেদন করে। আবারও একইভাবে আদালতে আসে না। অথচ ভুক্তভোগী পরিবারকে বারবার আদালতে যেতে হয়। ভুক্তভোগী একেতো আপনজন হারিয়ে কষ্টের মধ্যে থাকে, তারপরও সে কতো বার আদালতে যাবে। এমন চলতে চলতে এক পর্যায়ে তারা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে। নতুন আইনে আসামি যখন জামিন-অযোগ্য থাকবে, তখন ভুক্তভোগী ও আসামি দুই পক্ষই তাড়াতাড়ি মামলাটি নিষ্পত্তি করতে চাইবে।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও ট্রাফিক পুলিশ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের অনেক অভিযোগ। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ইলিয়াস কাঞ্চন: বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ সম্বন্ধে নানা অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের প্রতিটা সেক্টরেই দুর্নীতি-অনিয়ম রয়েছে। বিআরটিএ-তে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যায়। সে কারণে হয়তো সেখানে দুর্নীতির সুযোগটা বেশি। দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজ থেকে দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ হলে বিআরটিএ থেকেও দুর্নীতিও বন্ধ হবে।

বাংলানিউজ: আপনি প্রিয়জনকে হারিয়ে, অন্যের প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য ২৬ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারপরও কিছু ব্যক্তি আপনার কাজের সমালোচনা করছেন। তাদের প্রতি আপনার বার্তা কী?

ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি আমার প্রিয়জনকে হারিয়েছি। যারা প্রিয়জন হারায়, তারাই এই কষ্ট অনুভব করতে পারবে। আমি নিরাপদ সড়কের জন্য যে আন্দোলন করছি, তার ফলে আমার স্ত্রী কিন্তু আর আমার কাছে ফিরে আসবেন না। তবে অন্য কেউ যেন আপনজনকে না হারায়, সে জন্যেই আমার আন্দোলন।

এ বছরেও পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যে পাঁচ হাজার মানুষ মারা গেছে, তার মধ্যে এক হাজারই পরিবহন শ্রমিক ও চালক। আমি আমার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকেও বাঁচাতে চেয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সড়কে নিরাপত্তার জন্যই আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। সুতরাং সবার কাছে আমার অনুরোধ, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’র বিরোধিতা নয়। পরিবহন শ্রমিক-চালক, পথচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যদি যার যার অবস্থান থেকে আইন মেনে চলি, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। আমাদের পরিবারগুলো বেঁচে যাবে।

 

 

 আরপি/এমএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top