স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রত্যয় ফুটে উঠেছে বাজেটে
করোনা মহামারি দুটি বছর দেশকে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে দেয়। তবে উন্নয়ন থেমে থাকেনি। করোনাকালীন সময়েও দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উদ্বোধনের আগেই সরকার দেশবাসীকে দিন বদলের নতুন স্বপ্ন দেখাল।
কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন স্লোগানে পেশ হলো জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩। এর মাধ্যমে কোভিড সংকট কাটিয়ে আবার উন্নয়নের ধারায় ফিরতে চায় সরকার, দেশকে নিয়ে যেতে চায় অনন্য উচ্চতায়। অনেকেই বাজেটকে দেখছেন নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় হিসেবে। বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এবারের বাজেটে স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রত্যয় ফুটে উঠেছে সব খাতেই।
বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
মহামারীর পর উন্নয়নের হারানো গতি ফেরার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী, যা বাংলাদেশের ৫১তম এবং মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট।
এর আগে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ সভায় বাজেট অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে দুপুরেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবন থেকে আসেন সংসদ ভবনে। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংসদ কক্ষে একসঙ্গে হেঁটে ঢোকেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এ সময় অর্থমন্ত্রীর হাতে ছিল মেরুন রঙের একটি ব্রিফকেস।
নানামুখী চাপের মধ্যেও দেশকে মহামারিপূর্ব উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে নিতে এবারের বাজেট পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সাধারণত বাজেট পেশের দিনটি সংসদ ভবনজুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। কিন্তু গত দুই বছরের চিত্র ছিল ভিন্ন। সংসদ ভবন এলাকায় প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি। আর মূল ভবনে স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেছেন। অধিবেশনেও চিরচেনা সেই উৎসবের আমেজ দেখা যায়নি দুই বছর। সর্বত্রই ছিল কঠোর সতর্কতা। সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগমও ছিল নিয়ন্ত্রিত।
বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার পর বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে যুবলীগ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ বাজেটে নিশ্চয়তা আছে। সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে আগের চেয়েও সাত হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সবদিক বিবেচনা করে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তদের বিষয়কে নজর দেওয়া হয়েছে। কাজেই এটা গরিবের বাজেট। ব্যবসাবান্ধব ও গণমুখী বাজেট। করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট।’
প্রস্তাবিত বাজেটকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি উৎসাহিত করা গরিববান্ধব বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। সেটির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তা কতদিনে শেষ হবে সেটি কেউ জানে না। সেজন্য আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সোশ্যাল সেফটি নেট বা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানো হয়েছে, যাতে নিম্নআয়ের মানুষ সুরক্ষা পায়। এটি গরিববান্ধব বাজেট।
যদিও ঘোষিত বাজেট উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বর্তমান সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, তাই এই সরকারের বাজেট দেওয়ার অধিকার নেই। তিনি বাজেটের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে চান না জানিয়ে বলেন, লুটপাটের হিসাব তৈরি করতেই সরকার এই বাজেট প্রস্তাব করেছে।
এমনিতে বাজেট উপস্থাপনের সময় সংসদ অধিবেশন কক্ষ পূর্ণ থাকে। করোনার কারণে ২০২০ সালে উপস্থিতি ছিল ৭৮ জন। গত বছর ২০২১ সালে সংসদে ছিলেন ১৭০ জন সংসদ সদস্য। এবার করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ সনদ পাওয়া সব সংসদ সদস্যই অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। সবমিলিয়ে সংসদ কক্ষে ছিলেন ২৬০ জন আইনপ্রণেতা। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন সংসদে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার জন্য নির্ধারিত গ্যালারিতে বসে বাজেট উপস্থাপনা অবলোকন করেন। এ দিন অধিবেশনের শুরুতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির কথা সংসদকে জানান।
গতবারের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী স্পিকারের অনুমতি নিয়ে স্বাগত বক্তব্য রেখে অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায় বাজেট পেশ করেন। শুরুতে পাঁচ মিনিটের মতো বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী এবং শেষে দুই মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে কথা বলেন। সবমিলিয়ে দুই ঘণ্টা ১০ মিনিটের বাজেট উপস্থাপনায় মাত্র সাত মিনিট তিনি বক্তব্য দেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি আমার বাজেট বক্তৃতাটি অডিও-ভিজুয়াল পদ্ধতিতে উপস্থাপন করবো। বাজেটে বিস্তারিত তথ্যাদি টেবিলে উপস্থাপিত রয়েছে। পঠিত বলে গণ্য করার জন্য অনুরোধ করছি। বাজেট উপস্থাপনা শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থবিল ২০২২ সংসদে উত্থাপন করেন। এরপর স্পিকার ১২ জুন বিকেল ৫টা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন মুলতুবি করেন।
সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাজেট পেশের পর ১২ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা হবে। পরদিন ১৩ জুন পাস হবে সম্পূরক বাজেট। এরপর নতুন অর্থবছরের বাজেটের ওপর আলোচনা করবেন সংসদ সদস্যরা। সবশেষে আগামী ২৯ জুন নতুন অর্থবছরের অর্থবিল পাস হবে। পরদিন ৩০ জুন পাস করা হবে বাজেট, যা কার্যকর হবে জুলাইয়ের প্রথম দিন।
এদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনটি বলেছে, প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়ন প্রভৃতি বিষয়গুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী বলে দাবি করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। সেই সঙ্গে কল্যাণমুখী বাজেট ঘোষণা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় সরকারের উচিত ছিল- করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা। কিন্তু তা না করে বাজেটে বরং বেতনবহির্ভূত অন্যান্য ভাতার করমুক্ত সীমা পাঁচ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের সঙ্গে দরিদ্র মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষেরা এতে উপকৃত হবেন।
অর্থমন্ত্রী কৃষিখাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানিয়েছে সিপিডি। তারা মনে করে, এই সময় মানুষকে স্বস্তি দিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি করা উচিত ছিল। এছাড়া পাচার হওয়া টাকা ফেরতের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তা অনৈতিক বলে মনে করে সিপিডি। সামগ্রিকভাবে সিপিডি মনে করে, বাজেটে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা অপরিপূর্ণ। নীতি-কৌশল যা নেওয়া হয়েছে তা অসম্পূর্ণ এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের সাপেক্ষে অপর্যাপ্ত। সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের মাত্রা খুব বেশি ধরা হয়নি। অন্যান্য বছরের মতেই বাড়ানো হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য। তবে কথা হচ্ছে যে- এটাও বাস্তবায়ন হবে কি না? কারণ, বর্তমান অর্থবছরে এখনও ৩৫ হাজার কোটি টাকার শর্টফল (ঘাটতি) রয়েছে। কাজেই টার্গেট হিসেবে ঠিক আছে, তবে অর্জন হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বাজেটে ব্যাংক-ঋণ নির্ভরশীলতার মাত্রাটা একটু বেশি বলে মনে করি। সরকারের চেষ্টা করা উচিৎ এটা কমানো। কারণ হলো- এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, আবার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে বাজেটে। যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। মূলত, বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটা নতুন কিছু নয়, প্রতি বছরই আমাদের এই চ্যালেঞ্জ থাকে।
বাজেট বাস্তবমুখী হয়েছে কি না এর জবাবে তিনি বলেন, যদি সর্বাত্মক চেষ্টা করা যায়, তাহলে অর্জন করা সম্ভব। সে চেষ্টার ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। আর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আহরণের টার্গেট অর্জন করা। এমনিতে বাড়তি রাজস্ব আহরণ করতে পারলেও আমাদের যে কর-জিডিপির হার সেটা দক্ষিণ এশিয়া ও পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন, কাজেই সে দিক থেকে টার্গেট ঠিক আছে।
বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্নজনরা মনে করছেন- সরকার গত দুই বছরে অনেক কাজই করতে পারেনি। উন্নয়নের গতিতে একটু ভাটা নেমে এসেছিল। সে হিসেবে এবারের বাজেটের স্লোগান হয়েছে সঠিক। সেই সঙ্গে স্লোগানের মতোই যেন উন্নয়নে গতি আবার ফিরে পায় সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন।
আরপি/এসআর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: