রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


নওগাঁয় অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বধ্যভূমি


প্রকাশিত:
৮ মার্চ ২০২১ ০১:৩৩

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:৫৭

ছবি: এখানে পুতে রাখা হয় ৩০ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালীর নিথর দেহ

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পায়নি সরকারি স্বীকৃতি। বধ্যভূমিগুলো অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ জানতেই পারছেনা সে জায়গাগুলোতে শুয়ে আছেন মুক্তিকামী বীর বাঙ্গালী। প্রবীণরাও ভূলতে বসেছেন তাঁদের। সরকারি উদ্যোগে এসব বধ্যভূমি সম্পর্কে তেমন কোন তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে সরকারিভাবে এসব বধ্যভূমির উন্নয়ন, সংস্কার বা অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়নি।

তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, এই উপজেলার সদর ইউনিয়নের মহাদেবপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বের কোনে, উপজেলা কমপ্লেক্সের দক্ষিণপার্শ্বে রঞ্জনীতলা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা, ডাকবাংলো মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে, আত্রাই নদী সংলগ্ন রাবেয়া পল্লী, আখেড়া গ্রামে, সিদ্দিকপুর গ্রামে, চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে, চকদৌলত গ্রামে, খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড়ে, হাতুড় ইউনিয়নের মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় পৃথক গণকবর রয়েছে। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বাজিতপুর গ্রামে অবস্থিত গণকবরে নওগাঁ জেলা পরিষদের উদ্যোগে প্রায় পাঁচ বছর আগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়। তবে সেখানে সীমানা নির্ধারণ ও বাউন্ডারী ওয়াল নির্মান না করায় এটি এখনও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বাকীগুলোর ব্যাপারে কোনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

সরেজমিনে মহিষবাথান গ্রামের বামনদহ বিল এলাকায় গিয়ে সেখানকার গণকবরের খোঁজ করলে গ্রামবাসীরা জানান, গণকবরস্থানটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এটি কোথায় ছিল তা গ্রামের কেউ আর বলতে পারেননা। এলাকার বীরমুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করে মহিষবাথান বাজারে পাওয়া গেল বয়সের ভারে নুব্জ প্রবীণ বীরমুক্তিযোদ্ধা সেরাতুন নবীর।

কথা বলতেই তিনি এই প্রতিবেদককে নিয়ে গেলেন সেখানে। গ্রামীণ ব্যাংক অফিসের পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে কলাবাগান ও ফসলের মাঠের ভিতর দিয়ে এক কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম বামনদহ বিলে। তিনি বিলের একটি পুকুরের পশ্চিম-দক্ষিণ পার্শ্বে সীম ক্ষেতের মাচা দেখিয়ে বললেন সেইখানেই পুতে রাখা হয় ৩০ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালীর নিথর দেহ। সেখানে একটি ক্যানেলের পাড়ে ছিল বিশাল পাকুড় গাছ। বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২৬ এপ্রিল সোমবার বেলা ১০টায় তিন দিক থেকে মহিষবাথান গ্রামে আক্রমণ চালায়।

আর্মিদের একটি গ্রুপ মহাদেবপুর-পোরশা সড়কের দেবীপুর হয়ে এখানে আসে। ২ নং গ্রুপটি মহাদেবপুর-কুঞ্জবন-মহিষবাথান আত্রাই নদীর বাঁধের রাস্তা দিয়ে আর ৩ নং গ্রুপটি আসে আত্রাই নদীপথে নৌকাযোগে। তিন দিক থেকে একসাথে মহিষবাথান হাটে ঢুকে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটতরাজ করে ৩৫ জন গ্রামবাসী ও হাটুরেকে আটক করা হয়। এরপর তাদেরকে বামনদহ বিলের পশ্চিমের দীঘিরপাড়ে নিয়ে গিয়ে হাত বেঁধে সারি করে দাঁড় করায়। তাদের বর্বরভাবে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে জখম করা হয়।

পরে ব্রাশফায়ারে তাদেরকে খুন করা হয়। ভাগ্যক্রমে মারাত্মক জখম নিয়ে বেঁচে যান ৫ থেকে ৭ জন। বাকীদেরকে বিল সংলগ্ন পাকুড় গাছের তলায় একসাথে মাটি চাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটির আর খোঁজ নেয়নি কেউ। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ২ জন ছিলেন বামনদহ গ্রামের। কয়েক বছর আগে তারাও মারা গেছেন।
মহাদেবপুর-পোরশা সড়কের খাজুর ইউনিয়নের দেবীপুর মোড় এলাকায় খোঁজ পাওয়া গেল আরও একটি গণকবরের। একইদিন এই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বর্বর পাক বাহিনী এলাকার ১৩ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে ধরে এনে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।

কাছেই পাওয়া গেল অমূল্য চন্দ্র বর্ম্মণ নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধকে। তার পিতা গোপাল চন্দ্র বর্ম্মণকে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। অমূল্য জানালেন দেবীপুর গ্রামে বাড়ি তাদের। ঘটনার দিন তিনি অন্যগ্রামে ছিলেন। পরে জানতে পারেন হানাদার বাহিনী তার পিতাসহ ১৩ জনকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে দেবীপুর গ্রামের আরও একজন ছিলেন। বাকীরা বাহিরের পথচারী। তিনি জানন, এই গণকবরের জায়গায় এখন ধানের আবাদ করা হয়েছে। কবরের চিহ্নটিও নেই। কেউ এই জায়গাটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি।

উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রায় পাঁচ বছর আগে নওগাঁ জেলা পরিষদ এটি নির্মান করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনী এখানে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে নিরিহ গ্রামবাসীদের অকাতরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই স্মৃতিস্তম্ভে পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত ৬ জন মুক্তিকামী শহীদের নাম খোদাই করা হয়েছে। এরা হলেন, জাহান আলী সরদার, জফি উদ্দিন সরদার, শফিউদ্দিন, আব্দুল জলিল মন্ডল, তায়েজ উদ্দিন মন্ডল ও হোসেন উদ্দিন।

এইগ্রামের পাশে চকদৌলত গ্রামে রয়েছে আরো একটি গণকবর। এখনে তিন জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী। খোঁজ করে একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে পাওয়া গেল। সাবেক শিক্ষিকা রোকেয়া হায়দার। তিনি চোখের জলে বর্ণনা দিলেন সেদিনের ঘটনার। তিন জন আর্মি সেখানে গিয়ে হানা দিয়ে হত্যা করে কফিল উদ্দিন, তার ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্র মোফাজ্জল হোসেন ও চার বছরের শিশু সোহেল রানাকে।

সরকারিভাবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রতিটি উপজেলায় বধ্যভূমি বা গণকবর তালিকাভুক্তির কাজ করেছে। মহাদেবপুর উপজেলা প্রকৌশলী সুমন মাহমুদ জানান, এখানে ৮টি গণকবরের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব স্থানে প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মান করা হবে বলেও তিনি জানান।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বদিউজ্জামান বদি জানান, মহাদেবপুরে কোন সম্মুখ সমর হয়নি। এখানকার বীরমুক্তিযোদ্ধারা ভারতে ট্রেনিং নিয়ে নওগাঁ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন।

তিনি বলেন, পাক হানাদার বাহিনী মহাদেবপুর সদরের ডাক বাংলোতে ব্রিগেড হেডকোয়াটার স্থাপন করে। রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ প্রভৃতি নামে এদেশের দোশরদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ, খুন ও ধর্ষণে লিপ্ত হয়। গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মহাদেবপুরের গণকবরগুলোর ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ না নিলেও সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উন্নয়ন করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা সমূহের সংরক্ষণ ও পূণনির্মান প্রকল্পের আওতায় ১২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মডেল স্কুল মোড়ের শহীদ স্মৃতি সৌধের আধুনিকায়ন করে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার ইউএনও মো. মিজানুর রহমান মিলন জানান, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১১৩ জন বীরমুক্তিযোদ্ধার কবর বাঁধাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ১৩ বীরমুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নির্মান করে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

মহাদেবপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ প্রামাণিক জানান, মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে উপজেলার ১০ টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে রাস্তা সেখানকার বীরমুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, এখানে মোট ২১৬ জন তালিকাভূক্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাঁরা সকলেই সরকারি ভাতা পান।

আরপি/ এসআই-৩



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top