রাজশাহী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


সাড়ে ৩ বছরে যাচাই হয়েছে ২৫ কলেজের কাগজপত্র * এর মধ্যে অবসরে গেছেন ৫০৭ শিক্ষক * চতুর্থ দফায় এখন যাচাই করছে মন্ত্রণালয় * বিরোধীদের হাতে যাচাই কাজ থাকায় এই পরিস্থিতি -সভাপতি, সকশিস * চাকরি আত্তীকরণের কাজটি একটু জটিল প্রকৃতির, অভিযোগ সঠিক নয় -ডিজি, মাউশি


প্রকাশিত:
১৪ জানুয়ারী ২০২০ ২২:৫৭

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৪৮

ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী সাড়ে ৩ বছর আগে ৩০২টি কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি আত্তীকরণ সম্ভব হয়নি। ফলে গত ১৬ মাসে ৫০৭ শিক্ষক বেসরকারিভাবেই অবসরে গেছেন। তারা সরকারি পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।খবর যুগান্তর।


লম্বা সময়ে মাত্র ২৫ কলেজের কাগজপত্র যাচাই শেষ হয়েছে। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তির ক্ষেত্রে বাগড়া দেয়া ব্যক্তিদের হাতেই আত্তীকরণের এই কাজ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ফলে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় দিন কাটছে শিক্ষক-কর্মচারীদের। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

প্রতি উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারি করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। হিসাব অনুযায়ী ৩২৫ হাইস্কুল ও ৩০২টি কলেজ সরকারি হওয়ার কথা। ২০১৬ সালের মে মাসে এ ঘোষণা দেয়ার পর থেকে এ সংক্রান্ত কাজ চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষকদের চাকরি আত্তীকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে কাগজপত্র ‘যাচাই’। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গত ৩ বছরে একই কাগজপত্র তিনবার যাচাই করেন। এভাবে কাজটি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

এর ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি আত্তীকরণ হচ্ছে না। আর সেটা না হওয়ায় বেসরকারি হিসাবেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি বেসরকারি হিসেবে অবসরেও যাচ্ছেন। ফলে তারা সরকারি পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০৭ জন এভাবে অবসরে গেছেন। আবার এতবার যাচাইয়ের পরও মন্ত্রণালয় ফের যাচাই করছে একই কাগজপত্র। এসব ঘটনায় শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।

এসব কলেজের শিক্ষকদের সংগঠন সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্প খরচে মানসম্মত শিক্ষা পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে ৩০২টি কলেজ সরকারি করেন।

অতীতে নজির থাকা সত্ত্বেও নির্বাচিত কলেজগুলোর শিক্ষকদের চাকরি যাতে ক্যাডারভুক্ত না হয়, সে লক্ষ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্দোলন হয়। আন্দোলনের মুখে এসব কলেজের শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হতে পারেননি।

তিনি বলেন, এখন জাতীয়করণের মূল কাজটি মাউশির যে শাখা করছে, সেটির বর্তমান পরিচালক উল্লিখিত শাহেদুল খবীর চৌধুরী। অপরদিকে ওই আন্দোলন চলাকালে যারা টি-শার্ট আর শাড়িতে ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ লোগো লাগিয়ে রাজধানীতে ঘোরাফেরা করেছেন ও ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার লাগিয়েছেন তারা ছিলেন ও আছেন এই কাজে বিভিন্ন ডেস্কের দায়িত্বে।

স্বাভাবিকভাবেই কাজটি পদে পদে বিঘ্নিত হয়েছে। এগোচ্ছে না শিক্ষকদের আত্তীকরণের কাজ। সব মিলে বিরোধীদের হাতে যাচাইয়ের কাজ থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয়করণ কলেজের শিক্ষকরা গত নভেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গোটা বিষয় অবহিত হওয়ার পর মন্ত্রী মাউশি সরেজমিন পরিদর্শনে যান। তখন তিনি এ সংক্রান্ত ফাইল দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।

এরপরই মাউশি থেকে ১৪০টি কলেজের ফাইল পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অথচ এর আগে ৩ বছরে গেছে মাত্র ৮৫টি। সবমিলে ৩০২টি কলেজের মধ্যে এখনও ৭৮টি কলেজের কাজ আটকা আছে মাউশিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজগুলো জাতীয়করণের কাজ বিলম্বিত করতে মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ৫৫টি ত্রুটি ‘আবিষ্কার’ করেন। অবশ্য এর মধ্যে বেশকিছু যৌক্তিক বলে জানা গেছে।

এগুলো হচ্ছে নিয়োগের ব্যাপারে শূন্যপদ, গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত, বোর্ড গঠন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ ও এর নম্বরপত্র, প্রার্থীর কাম্য যোগ্যতা, নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র ইত্যাদি।

এছাড়া নিয়োগ বোর্ডে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাউশির মহাপরিচালকের প্রতিনিধির চিঠিসহ আরও কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কলেজ ও প্রার্থী প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।

তবে বেশির ভাগ তথ্যই সেফ হয়রানির লক্ষ্যে চাওয়া হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষক নেতা জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মৌলিক তথ্যের ঘাটতি থাকলে চাকরি আত্তীকরণ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেসব ত্রুটি ধরেছেন তা ত্রুটির মধ্যেই পড়ে না।

যেমন ২০০৫ সালের আগে মহাপরিচালকের প্রতিনিধির চিঠি বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু সেটি চাওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে মূল পত্রিকা চাওয়া হচ্ছে, কাটিং গ্রহণযোগ্য নয়।

কলেজের স্মারক বই চাওয়া হচ্ছে। মূল্যায়ন শিটের ফটোকপি গ্রহণ করছে না। অথচ মূলটি কলেজের কাছে থাকে, প্রার্থীর কাছে নয়। আসলে এভাবে ধরাটা উদ্দেশ্যপূর্ণ। লক্ষ্য হচ্ছে, কাজ বিলম্বিত করা।

এ ব্যাপারে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘চাকরি আত্তীকরণের কাজটি একটু জটিল প্রকৃতির। এছাড়া একসঙ্গে অনেক কলেজের শত শত শিক্ষক-কর্মচারীর কাগজপত্র দেখতে হচ্ছে।

তাই নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ে একটু সময় লাগতেই পারে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিলম্বিত করার অভিযোগ সঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘অধিদফতরের কাজ শেষের পথে। আমরা খুবই দ্রুততার সঙ্গে কাজগুলো করার চেষ্টা করছি।’

সূত্র জানায়, মাউশির তদন্তে আস্থা না থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন যাচাই করছে। মাউশি চিহ্নিত ৫৫ সমস্যা থেকে মন্ত্রণালয় ৮টিকে মূল ধরে সেগুলোর ভিত্তিতে কাগজপত্র যাচাই করছে। ইতিমধ্যে মাউশি থেকে পাঠানো ২২৫টি কলেজের তথ্য যাচাইয়ে মন্ত্রণালয়ের ৪টি গ্রুপ কাজ করছে।

মন্ত্রণালয়ের ফের যাচাইয়ের যৌক্তিকতা সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, যারা শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদার বিরোধিতায় ছিল তারাই আত্তীকরণের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করছেন।

তারা ইচ্ছা করেই যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি ও বিলম্বিত করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। এ কারণেই এই যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আত্তীকরণের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষকদের অভিযোগও একই।

এদিকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কলেজগুলোর মধ্যে ২৫টির পুনঃযাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) বেলায়েত হোসেন তালুকদার। তিনি বলেন, অধিদফতর জাতীয়করণ কলেজগুলো পরিদর্শনসহ নথিপত্র যাচাই করেছে।

কিন্তু দুটি কারণে মন্ত্রণালয়কে যাচাই করতে হচ্ছে। এক. পরিদর্শনে যাওয়া কারও কারও ব্যাপারে অযোগ্যদের পার করে দেয়ার অভিযোগ এসেছে। দুই. কেউ কেউ না বুঝে অযোগ্যদের পার করে দিয়েছে।

যেহেতু আত্তীকরণে চাকরি সরকারি হবে এবং এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত যোগ্যতা ও শর্ত আছে, তাই নথিপত্র ভালোভাবে যাচাইয়ের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এ কাজে মূল বিলম্ব হয়ে গেছে অধিদফতরে।

আমরা এখন দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি। তবে যে কাজ বাকি আছে, তাতে মনে হচ্ছে শিক্ষক আত্তীকরণের কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরও দেড় বছর লেগে যেতে পারে।

যুগান্তরের অনুসন্ধানেও অতিরিক্ত সচিবের কাছে আসা অভিযোগের কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার একটি কলেজের অধ্যক্ষের যোগ্যতা নেই। এর আগে যাচাইয়ে তাকে অযোগ্য মন্তব্য করে চাকরি আত্তীকরণের বিপক্ষে মতামত ছিল।

কিন্তু মাউশির এক উপপরিচালকের সঙ্গে রফা হওয়ায় ওই অধ্যক্ষ পার পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজের ৮ ব্যক্তিকে শিক্ষক সাজিয়ে জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রত্যেকের যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালে। অথচ ২০০৯ সালে সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) তদন্তকালে এসব ব্যক্তি কর্মরত ছিলেন না। দিনাজপুরের আদিতমারী কলেজের ৫ জনকে একইভাবে আত্তীকৃত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা, নওগাঁর রানীনগর উপজেলাসহ একাধিক কলেজের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি আত্তীকরণের সুপারিশ পেয়েছে বলে জানা গেছে, যা যোগ্যতা-শর্ত পূরণ করে না। এ ক্ষেত্রে মাউশির কলেজ শাখার তিন অসাধু কর্মকর্তা ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা মোট তিন দফায় কলেজগুলো পরিদর্শন ও তথ্য যাচাই করা হয়। ২০১৬ সালে কলেজগুলো জাতীয়করণে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর মাউশির টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে ও প্রত্যেক শিক্ষকের কাগজপত্র যাচাই করে। এরপর জাতীয়করণের গেজেট হওয়ার কথা।

কিন্তু ক্যাডার কর্মকর্তাদের আন্দোলন ও রিটের কারণে ২ বছর ২ মাস ১৪ দিন বিলম্বে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই নতুন সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষকরা নন-ক্যাডার মর্যাদা পাবেন।

অথচ দেশ স্বাধীনের পর আগের সব বিধিতে ক্যাডার মর্যাদা দেয়া হতো। এরপর ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের আদেশ (জিও) জারি করা হয়। জাতীয়করণের গেজেট হওয়ার পর আবার প্রত্যেক শিক্ষককে সব কাগজপত্র মাউশি অধিদফতরে জমা দিতে বলা হয়।

এরপর দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে কয়েকটি কলেজ বেছে নিয়ে পদ সৃজনের জন্যও কিছু কলেজের কাগজপত্র নেয়া হয়। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে ফের প্রত্যেক শিক্ষকের কাগজপত্র যাচাই শুরু করে মাউশি।

আর এখন যাচাই করছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষ হলে শিক্ষক-কর্মচারীদের ফাইল যাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এরপর ফাইল যাবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি)।

 

আরপি/এমএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top