রাজশাহী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

বরেন্দ্র অঞ্চলে লাভের আশা দেখাচ্ছে বেড প্লান্টিং চাষ


প্রকাশিত:
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৭:১৮

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৭

ছবি: সংগৃহীত

কম খরচে বেশি লাভ আশায় বরেন্দ্র অঞ্চলে আশা দেখাচ্ছে আধুনিক চাষের কৌশল বেড প্লান্টিং। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরেন্দ্রখ্যাত উত্তরাঞ্চলে সেচের পানি সংকট পুরনো। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখানে প্রলম্বিত হচ্ছে খরা। সংরক্ষণশীল এ কৃষি পদ্ধতিতে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, সরিষা, পাট, তিল, বাদাম, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে চাষে সেচ, সার ও খরচ বাঁচবে কৃষকের।

কৃষকরা বলছেন, যেকোনো পাওয়ার টিলারের সঙ্গে ‘বেড প্লান্টার’ যন্ত্রটি যুক্ত করে সরাসরি জমি তৈরি, বীজ বপন, মই দেয়া ও বেড তৈরির কাজ এক চাষেই হয়। স্বাভাবিক পদ্ধতির বাড়তি চাষ-মই দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এতে সার-বীজ সঠিক গভীরতায় পড়ে। ফলে বীজের অঙ্কুরোদ্মম ক্ষমতা বাড়ে। দুই লাইনের মধ্যবর্তী স্থানে জমি চাষ পড়ে না। ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে নাড়া।

‘বেড প্ল্যান্টার’ যন্ত্রে বেড তৈরি করে চাষাবাদ করার ফলে কম সময়ে জমি যেমন তৈরি করা যায়; তেমনি সার, বীজ এবং পানির অপচয় কম হয়। আধুনিক এ পদ্ধতিতে এক চাষেই জমি তৈরি, সার দেওয়া, বীজ বপন, মই দেওয়া ও বেড তৈরির কাজ হয়। সার-বীজও সঠিক গভীরতায় পড়ে। ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া প্রচলিত চাষাবাদের তুলনায় বেড-নালা পদ্ধতিতে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে।ফলে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আধুনিক এই চাষপদ্ধতি।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাত্র ৭০ কৃষক বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ শুরু করলেও চলতি মৌসুমে কৃষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজারের বেশি। আর আবাদ বেড়েছে ১৮ হেক্টর থেকে ৬ হাজার ৮০০ হেক্টরে। সে হিসেবে গত ২০ বছরে আবাদ বেড়েছে ৩৭৮ গুণ। ব্যয়সাশ্রয়ী চাষ ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মাঝে জনপ্রিয়তা বাড়ছে বেড প্লান্টিংয়ের।

বেড প্লান্টিং ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিডব্লিউএমআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাজশাহী অঞ্চলপ্রধান ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন। তিনি এক হিসাবে দেখিয়েছেন, ভুট্টা চাষের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমি চাষে খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। বীজ বপনে শ্রমিক খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। নালা তৈরিতে আরো শ্রমিক খরচ প্রায় ১১ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে হেক্টরে কৃষকের খরচ হয় ৩৮ হাজার টাকা। কিন্তু বেড পদ্ধতিতে মাত্র একটি চাষেই বেড তৈরি, বীজ বোনা ও চাষ হয়ে যায়। এতে সাকল্যে খরচ পড়ে ১০ হাজার টাকা। এই পদ্ধতিতে চাষে হেক্টরে ২৮ হাজার টাকা সাশ্রয় হয় কৃষকের। অর্থাৎ প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বেড প্লান্টিংয়ে খরচ কমে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্যদিকে প্রচলিত পদ্ধতিতে গম চাষে হেক্টরে খরচ ১৫ হাজার টাকা হলেও বেড প্লান্টিংয়ে খরচ হয় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে নানা সংকটে গম-ভুট্টা চাষ ধীরে ধীরে কমে আসছিল। তবে আধুনিক বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় আবারও পুন ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। ২০০৩ সালে রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার মাত্র ৭০ জন কৃষক ১৬ নেতার জমিতে লেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ শুরু করেন। ভালো ফলন পেয়ে চাষিদের মাঝে জনপ্রিয় হতে থাকে এই পদ্ধতি। প্রচলিত পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষে এক হেক্টর জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩৮ হাজার টাকা। কিন্তু বেড পদ্ধতিতে কৃষকের খরচ পড়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-২২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ২৩ হাজার ৭৮৭ হেক্টর জমিতে গম এবং ৫১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। ওই মৌসুমে ৯৫ হাজার ১৪৮ টন গম এবং ৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৯ টন ভুট্টা ঘরে তুলেছিলেন কৃষক।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দশক আগেও এ অঞ্চলে গম-ভুট্টার আবাদ ছিল প্রায় অর্ধেক। নানা সংকটে চাষীরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু উচ্চফলনশীল জাত, চাষের আধুনিক কৌশল ও বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক ফিরেছেন গম-ভুট্টা চাষে। একই সঙ্গে বেড প্লান্টিংয়েও আগ্রহ বাড়ছে চাষীদের। রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ২০০৩ সালে মাত্র ৭০ কৃষক বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ করেন। তারা মাত্র ১৮ হেক্টর জমিতে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। ভালো ফলন পাওয়ায় এরপর থেকেই কৃষকের মাঝে জনপ্রিয় হতে থাকে বেড প্লান্টিং।

২০১০ সালে বিভাগের ১৪ হাজার ৫০০ কৃষকের ৪ হাজার ৬৯২ হেক্টর জমি এ প্রযুক্তিতে চাষাবাদ হয়। ২০১৫ সালে ২৫ হাজার কৃষক এ পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ করেন। সে বছর এ পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আসে ৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমি। চলতি মৌসুমে বিভাগের আট জেলার প্রায় ২৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেছেন।

রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা উপজেলার মুরালিপুর গ্রামের চাষি মো. ওমর ফারুক, আশিকসহ অনেকেই জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে হাত দিয়ে ছিটিয়ে গম ও ভুট্টা রোপণ করলে কোথাও বেশি কোথাও কম গাছ বের হতো। এছাড়া চাষাবাদের খরচও অনেক বেশি ছিল। তবে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের সময় একই সঙ্গে বেড ও নালা তৈরি হয়। বেডের ওপর ফসল ও নালায় পানি দেওয়া হয়। এতে সেচ কম লাগে। কম পানিতে গম-ভুট্টার বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হচ্ছে।

একই এলাকার মো. বেনু নামে আরেক কৃষক বলেন, এ পদ্ধতিতে ফসলের শেকড় মাটির গভীরে থাকায় গাছ হেলে পড়ে না। আবার বেডের সঙ্গে নালা থাকায় আগাছা দমন সহজ হয়। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করায় ইঁদুরের আক্রমণও হয় না। একই বেড না ভেঙে বিভিন্ন ফসল চাষ করা যায়। ব্যয়সাশ্রয়ী এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে ভালো ফলন মিলছে।

বেড পদ্ধতিতে গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউনিয়নের বাওইডাঙ্গায় ২০ বিঘা ভুট্টা চাষ করেছেন স্থানীয় কৃষি উদ্যোক্তা জাকারিয়া পারভেজ। তিনি বলেন, ‘তার গবাদিপশুর খামার রয়েছে। সেই সঙ্গে সারা দেশেই আমরা গো-খাদ্য সরবরাহ করি। গো-খাদ্য হিসেবে এ বছর ১০০ বিঘা ভুট্টা চাষ করেছি। এর মধ্যে ২০ বিঘা চাষ করেছি বেড প্লান্টারে। তিনি আরো বলেন, এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গম-ভুট্টা চাষ হয় এ পদ্ধতিতে। কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে তিনি জানতে পেরেছেন এ পদ্ধতিতে চাষে খেতে পানি জমে না, গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়, সেচও কম লাগে। বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি এ পদ্ধতিতে চাষে নেমেছেন এবার। ভালো ফলন পেলে পরের সব চাষ বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতেই করবেন।

কথা হয় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক সিনিয়র স্পেশালিস্ট ড. মনোয়ার করিম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে আবাদি জমি। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে উৎপাদনশীলতা কমছে। খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবেলায় খাদ্য ও পুষ্টি উৎপাদন বাড়াতে বেড প্লান্টিং পদ্ধতিতে চাষের বিকল্প নেই।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতি কৃষি ও কৃষকবান্ধব একটি ভালো উদ্যোগ। বেড প্ল্যান্টিং উত্তর-দক্ষিণমুখী ও ফাঁকা ফাঁকা হওয়ায় আলো-বাতাস ভালো লাগে। এতে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। এছাড়া ইঁদুর অন্ধকার ও জরাজীর্ণ জায়গা পছন্দ করায় এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা ফসলের ক্ষতি করতে পারে না।

 

আরপি/ এমএএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top