‘গরিবের পেট, বাহিরে না এসেও উপায় নেই’
ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতে নাকাল হয়ে পড়েছে উত্তরের জনপদ। গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহীতেও জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের দাপটে জবুথবু হয়ে পড়েছে পদ্মাপাড়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
রোদহীন নগরীতে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। ঘন কুয়াশা আর শৈত্যপ্রবাহে কাজে যোগ দিতে পারছেন না অনেকেই। সামান্য উপার্জনে চাল-ডাল জোটানোই যাদের প্রধান লক্ষ্য, শীত নিবারণের পোশাক কিনতেও হিমশিম অবস্থা তাদের। দিনের আলো ফুটতে দেরি হওয়ায় কাজ না পেয়ে অলস সময় পার করছেন শ্রমজীবীরা।
রাজশাহীর পদ্মা গার্ডেনে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় দোকান খোলা থাকলেও অনেকটাই জনশূন্য পুরো গার্ডেন এলাকা। হরেক রকম খাবারের পসরা নিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো অনেকটাই সুনসান। টেবিল-চেয়ার সাজানো থাকলেও অলস সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা।
তাদেরই একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ আব্দুল মালেক। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজশাহী নগরীর পদ্মা গার্ডেনে ছোট বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করছেন তিনি। মৃদু শৈত্যপ্রবাহে যখন কাবু হয়ে পড়েছে রাজশাহীর জনজীবন, তখনও শীত উপেক্ষা করে বেড়িয়েছেন জীবিকার তাগিদে।
কনকনে শীতে বাহিরে বের হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর বড়কুঠি পাড়ার এই বাসিন্দা বলেন, ‘গরিবের পেট, বাহিরে না এসেও উপায় নেই। আমাদের তো দিন এনে দিন খাওয়া। সঞ্চয় বলতে কিছু থাকে না। কামাই না হলে পেটে কিছু জুটবে না।’
বেচাবিক্রি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে খুব কম, বেচাকেনাই হচ্ছে না। শুক্রবার-শনিবার সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়, কিন্তু এবার সেটাও নাই। অন্য সময় দৈনিক দুই-তিন হাজার টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু এখন সারাদিনে ৬০০ টাকার বিক্রি করতেই হিমশিম খেতে হয়।’
পদ্মা গার্ডেনের ফুচকা বিক্রেতা কবির হোসেন। শীতের প্রকোপে লোকজন বের হতে না পারায় বিষণ্ন মনে দোকান খুলেছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লোকজন ফাঁকা, দেখতেই পারছেন সব সিট ফাঁকা। শীতের শুরু থেকেই লোক কমতে শুরু করেছে। আগে রাত ১০টা পর্যন্ত লোক থাকতো, এখন সাড়ে ৭টাও বাজতে হয় না। তার আগেই সব লোক চলে যায়।’
এদিকে পদ্মাপাড়ের নগরী তো বটেই পুরো রাজশাহীতে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পেয়ারাসহ বিভিন্ন টক-ঝাল মাখা। সেই জনপ্রিয়তার কমতি নেই পদ্মার তীর ঘেঁষা গার্ডেনে। সম্প্রতি রাজশাহীতে পদ্মা পাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পেয়ারার দোকান।
পদ্মা গার্ডেনে পেয়ারার দোকানে বসা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘লোকজন তো বেশি নাই। কালকে (শুক্রবার) কিছুটা বিক্রি হয়েছিল কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেনি। শীতের সময় রাত ৮টার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। গরমের সময় ১০টা পর্যন্ত লোক থাকে। আর আজকে (শনিবার) তো দেখতেই পারছেন ফাঁকা। এরকম টাইমে শনিবার-শুক্রবারের দিন সব তো বন্ধ থাকে লোকজনে ভরে যায়।’
জানা যায়, মনিরুল ইসলাম নগরীর সূর্যকণা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি বিকেলের অবসরে বাবার পেয়ারা দোকানে সহায়তা করে । আর দিনভর পরিশ্রম শেষে একটু বিশ্রামের সুযোগ মেলে বাবার।
আরেক ফুচকা বিক্রেতা আফসারী বেগম জানান, ‘এখন তো শীতের কারণে বেচাবিক্রি নাই, বেচা বেশি হয় বর্ষাকালে। গরম-বর্ষাতে লোক ঘুরতে আসে আর নদীতে পানিও ভরা থাকে, লোকজন দেখতে আসে।’
আফসারী বেগমের ছেলে বলেন, ‘বেচাকেনা অনেক কম। গরমে ভালো বিক্রি হয়। শীতে ৮০ শতাংশ কমে গেছে। এখন সারাদিনে যে বিক্রি হচ্ছে সেটা অন্য সময় এক বেলাতেই হতো। আর সকালে বা সন্ধ্যার পর তো কাউকে পাওয়াই যাচ্ছে না, সবাই শীতের জন্য বাসায় চলে যায়। ব্যবসা অনেক কমে গেছে। লোকজন যে কয়জন আছে তারাও বাজারে।’
এদিকে আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, রোববার (৮ জানুয়ারি) সকালে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যা এবারের শীত মৌসুমে রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড করেছে। এর আগে গতকাল (শনিবার) ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। গত শুক্রবার রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। আর বুধবার ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মঙ্গলবার ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সোমবার ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস সহকারী কামাল উদ্দিন বলেন, আজ (রোববার) রাজশাহীতে সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এর আগে গতকাল (শনিবার) ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
আজ সকালে দৃষ্টিসীমা একটু বেশি ছিল, প্রায় আড়াইশ মিটারের মতো ছিল। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ মেঘ-কুয়াশা কম রয়েছে। এমনকি সকাল ৯টার পরপরই সূর্য দেখা গেছে। চলমান মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আগামী ১১জানুয়ারির পর তাপমাত্রার উন্নতি হলেও আকাশ মেঘলা ও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।
এদিকে আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ার কারণে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকতে পারে।
উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুকনো থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
আরপি/এসআর-০২
বিষয়: মানবিক স্টোরি শীত আবহাওয়া
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: