রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের গন্ধমাখা হাজারদুয়ারি প্রাসাদে একদিন


প্রকাশিত:
২৮ জুলাই ২০২২ ২৩:১৬

আপডেট:
৩০ জুলাই ২০২২ ০২:৩২

ফাইল ছবি

ব্রিটিশ যুগে বাংলার এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হল হাজারদুয়ারি। বিশালাকার এই প্রাসাদে প্রত্যেকটি হলঘর অনুপম সৌন্দর্যের আলোকে সজ্জিত। বাংলার নবাবি আমলে স্থাপত্যকলার এক উজ্জল প্রতিফলন হল এই হাজারদুয়ারি প্রাসাদ । এই প্রাসাদটি বহু দরজাবিশিষ্ট বলে তাই একে 'হাজারদুয়ারি' নামকরণ করা হয়।

দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের জন্য একটি অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানে মাসে অন্তত ৩০০০০ মানুষ এর অনুগমন হয়,হাজারদুয়ারির অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় লালবাগ নামক অঞ্চলে।

প্রাসাদটির নিচতলায় অস্ত্রাগারে প্রায় ৭০০ দুর্লভ অস্ত্র রয়েছে। এখানে এমন সব অস্ত্র আছে যেগুলো পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। তৎকালীন নবাবদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র যেমন তরবারী, বহু নল বিশিষ্ট বন্দুক, বিভিন্ন ধরনের কামান, রাইফেল, বিভিন্ন ধরনের ছোরা, এমনকি মোহাম্মদী বেগ তরবারি দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা কে হত্যা করেছিলেন সেটিও এখানে আছে।

দোতালায় আর্ট গ্যালারি আছে সেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যায় মুর্শিদকুলি খানের মার্বেল পাথরের সিংহাসন, , হাতির দাঁতের পালকি, রুপোর পালকি, তখনকার সময়ে বিভিন্ন চীনা মাটির তৈরি আসবাবপত্র, মমি করা বিভিন্ন প্রকারের দুষ্প্রাপ্য পাখি, এছাড়াও দরবারে রয়েছে মহারানী ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১ টি বাতি যুক্ত সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। নবাবের তলোয়ার । আর সবচেয়ে আষ্চার্যের বিষয় হলো নিজের মুখ দেখা যায়না এমন আয়না আছে সেখানে।

তৃতীয় তলায় লাইব্রেরীতে অনেক ধর্মপুস্তক, তৎকালীন সাহিত্য তাম্রলিপি, ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র, প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ, বৈদেশিক ভাষায় গ্রš’, সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরীর পান্ডুলিপি, বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুনুর রশিদের নিজ হাতে লেখা কোরআন শরীফের কপি ইত্যাদি দুর্লভ সংগ্রহ আছে।

বাংলার শেষ নবাব সিরাজ–উদ–দউল্লার রাজধানি মুকসুদাবাদ বা এখনকার মুর্শিদাবাদ আজও ইতিহাস যেখানে কথা বলে। ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা, হাজার দুয়ারি, ইমামবড়া, মদিনা মসজিদ, নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার নিউ প্যালেস, ঘড়ি ঘর, বাচ্চেওয়ালি তোপ– কি নেই। সব একসাথে আপনার সামনে এনে দেবে এক হাজার বছর পুরনো ইতিহাস।

১৭শ শতাব্দী থেকে ইংরেজ শাসনের আগে পর্যন্ত সুবা বাংলা, বিহার ও ওড়িষার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ শহর ৷ এখানে রাজত্ব করতেন নবাবরা ৷ এখানকার নবাব হুমায়ুন জা ইউরোপিয় স্থপতি দিয়ে এই প্রাসাদ বানান ৷

মদিনা মসজিদ

ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারি প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি মদিনা মসজিদ। এর আকার বেশ ছোট। আসলে এটি মসজিদের আকৃতি বিশিষ্ট একটি ছোট ভবন। এটি মূলত হযরত মুহম্মদ (সা.) মদীনার রওজা মোবারকের অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি।

যুবরাজ সিরাজ যখন নবাব হলেন, তখন সুদূর মদিনা থেকে মাটি এনে প্রথমে নৌশেরি বানুর সমাধি মসজিদে রাখা হয়। নির্মাণকালে এর দরজাটি বহু মূল্যবান রত্নখচিত করা হয়েছিল, যা ইংরেজদের যোগসাজশে মীর কাশিম কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। দশম শতকে মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এটি। হাজার দুয়ারী ভবন ও ইমামবাড়া মসজিদের মাঝখানে সিরাজের স্বপ্ন দ্বারা তৈরি মদিনা মসজিদ। সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগম মানত করেন তার ছেলে নবাব হলে কারবালা প্রান্তর থেকে মাটি এনে মুর্শিদাবাদে মদিনা মসজিদ তৈরি করবেন। তাই সিরাজ নবাব হয়ে তার প্রিয় মায়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন মদিনা মসজিদ তৈরি করে।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘড়ি ঘর

বাংলার নবাবদের শহর মুর্শিদাবাদে রয়েছে এক বিখ্যাত ঘড়ি মিনার। এটি পরিচিত ‘ঘড়িঘর বা ‘ঘড়ি মহল’ নামে। স্থানীয় মানুষ এই মিনারকে ‘মুর্শিদাবাদের বিগ বেন’ নামেও ডেকে থাকেন। ঘড়িঘরের অবস্থিত পুরো চত্বরকে বলা হয় নিজামত কিলা বা কিলা নিজামত।


ভাগীরথী নদীর পূর্ব পাড়ে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ এবং নিজামত ইমামবাড়ার মাঝখানে প্রাঙ্গণে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘড়ি ঘর। সগুর মিস্ত্রির নকশাতে এই সুন্দর ঘড়ি মহল গড়ে উঠেছিল। ডানকান ম্যাকলিওডের বাঙালি সহকারী সগুর মিস্ত্রি। মনে করা হয়, ভাগীরথী নদী দিয়ে যাতায়াত করা নৌকো এবং অন্যান্য জলযানের যাত্রী ও চালকের সুবিধার্থেই এই মিনার তৈরি করা হয়েছিল। সম্ভবত ওই কারণেই ঘড়ির মুখ নদীর দিকে। ভাগীরথীর অন্য পাড় থেকেও দেখা যায় ঘড়ি। মিনারের শীর্ষে রয়েছে এক গম্ভীর শব্দের ঘণ্টা। বহু দূর থেকে ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যেত।বহু বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। ঘড়ির কাঁটা গুলো আজ আর নেই। কেবল একটি অকেজো স্থম্ভ হয়ে পড়ে রয়েছে।

১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদ কুলি খা–র তৈরি কাটরা মসজিদ, যেখানে রয়েছে তাঁর সমাধি। এছাড়াও মিরজাফর–এর সামাধি, সিরাজের সমাধি, সব কিছু আপনাকে রোজকার একঘেয়েমি থেকে নিয়ে যাবে এক অন্য ভারতবর্ষে। এছাড়াও ঘুরে আসতে পারেন পলাশীর যুদ্ধ প্রান্তর। ভাগীরথীর বুকে নৌবিহার আপনার মনে একে দেবে এক অবিস্মরণীয় ছবি।

যেভাবে যাবেন

শিয়ালদা থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস বা ভাগীরথী এক্সপ্রেস কিম্বা হাওড়া থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে যাওয়া যেতে পারে, সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। এখানে যাওয়ার সবথেকে মনরম সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ মাস।

 

আরপি /আইএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top