রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১

শীতের বার্তা নিয়ে দুয়ারে এলো হেমন্ত


প্রকাশিত:
১৭ অক্টোবর ২০২১ ০৬:২৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৩০

ছবি: রাজশাহী পোস্ট

“এদেহ অলস মেয়ে/পুরুষের সোহাগে অবশ/চুমে লয় রৌদ্রের রস/হেমন্ত বৈকালে/উড়ো পাখপাখালির পালে/উঠানে পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ/অঘ্রাণের মাঝরাতে...” রূপসী কবি জীবনানন্দ দাশের ‘পিপাসার গান’ কবিতায় লেখা পংক্তির মতোই প্রেমে-কামে, দেহে-দেহহীনতায়, সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে ও বিরতিতে আগমন ঘটলো ঋতুকন্যা হেমন্তের।

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। পালা করে এক ঋতু যায় আর অন্যটি আসে। আর একটি ঋতু পুরোপুরি যাওয়ার আগেই হাজির হয় পরবর্তী ঋতু আসার আগমনী বার্তা। আজ কার্তিকের পহেলা দিন। চারদিকে কুয়াশার মৃদু আবরণ আর নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ জানান দিচ্ছে হেমন্তের উপস্থিতি। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস জুড়েই বাংলাদেশে হেমন্তের বিস্তৃতি। শরতের কাশফুল মাটিতে নুইয়ে পড়ার পরপরই বাংলার রূপবৈচিত্র্যে হাজির হয় হেমন্ত। হেমন্ত ম্লান, ধূসর, অস্পষ্ট, অদৃশ্য, শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত এমন তীব্র প্রখর বা উন্মোচিত নয়। বসন্তের মতো তার নিজস্ব কোনো বর্ণ গন্ধ কিংবা গরিমা নেই। হেমন্ত মৌন শীতল ও অন্তর্মূখী।

‘কোন পাহাড়ের ওপার থেকে আনলো ডেকে হেমন্তকে’ কবি সুফিয়া কামালের এই পংক্তির মতো হেমন্তকে স্বাগত জানায় এমন অনেক কবিতা আছে বাংলা সাহিত্যে। হেমন্তে ফোঁটা শিউলী, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজ অশোক প্রভৃতি ফুলের সৌরভ বাঙ্গালির প্রাণে সঞ্চার করে নতুন আমেজ। ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে ছড়িয়ে থাকা মুক্ত দানা আর ফসলের সোনালি সমুদ্র সবমিলিয়ে যেন পূর্ণতা পায় প্রকৃতি। হেমন্তের সকালে শিউলীর সৌরভে বাঙালির প্রাণে আসে উৎসবের আমেজ।

হেমন্ত মানেই শীতের পূর্বাভাস। কুয়াশাভেজা শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হেমন্ত উকি দেয় দোর গোড়ায়। শিশির ভেজা ঘাস আর কুয়াশার চাদর সেটিই জানান দিচ্ছে। নগরীর ইট কাঠের ভিড়ে শীতের পরশ পেতে দেরি হলেও ইতোমধ্যে গ্রামে উঁকি দিতে শুরু করেছে শীত। প্রকৃতি সুশোভিত হচ্ছে এক নতুন আমেজে। গ্রাম বাংলা সেজে উঠছে নতুন রূপে। শীতের সকালে খেঁজুর রস খাওয়া, কুয়াশাভেজা পথে চাদর মুড়ি দিয়ে পথচলা আর মুহুর্মুহু গানে কৃষকের ধান কাঁটা, দিন শেষে ধান মাড়াই আর রাত জেগে জেগে তা উনুনে সেদ্ধর ব্যস্ততায় ভরে উঠবে কৃষকের জীবন। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় কষ্টের নয়, ফুটে ওঠে আনন্দের প্রতিচ্ছবি। সব মিলে গ্রামীণ জীবনে এনে দেয় নতুন রোমাঞ্চ।

সুউচ্চ ভবনে বসবাসরত সুবিশাল আলোয় আলোকিত যান্ত্রিক জীবনের লোকেরাও পিছিয়ে থাকে না শীতের এই আমেজকে উপভোগ করা থেকে। শীতকালীন সবজিতে ভরপুর থাকে শহরের বাজার। মাগরিবের আগ থেকেই মোড়ে মোড়ে বসে পড়ে হরেক রকম পিঠার পসরা। তবে প্রযুক্তির প্রভাবে আবহমান কাল ধরে চলা গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য ক্রমেই বিলুপ্তির পথে বলে মনে করেন প্রকৃতিবিদরা।

হেমন্তে কুয়াশা ভেদ করে লাল আভা বেয়ে পুব আকাশে উঁকি দিতে খানিকটা বেগ পেতে হলেও মায়াবী আলোয় ভরে থাকা চারপাশে সজীবতা ফিরে মনে। দৃষ্টিসীমায় কুয়াশার প্রলেপ জমলেও সূর্যের আলো ফোটার আগেই আড়মোড়া ভেঙে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের মানুষজন। কনকনে বাতাস না বইলেও কুয়াশা ভেজা ঘ্রাণ জানান দেয় শীতের আগমনী। সবুজ ঘাসে, গাছের পাতায়, নতুন কুড়িতে কিংবা মাকড়সার জালে মুক্তর মালার মতো জমে শিশির।

হেমন্তে সারাদিন ধরে হিম মাখানো হালকা হাওয়ায় ঝরঝর করে ঝরে পড়ে গাছের পাতা। প্রকৃতির বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে ওঠার বিদায় উৎসব যেন হেমন্ত। হাওয়ায়-হাওয়ায় সোনাঝরা রোদ্দুরেও শোকার্ত মানবীর মতো বাতাসের আন্দোলন ঘিরে অবিরাম শব্দ উঠে বুকফাটা হাহাকারের। আর হাওয়ায় হাওয়ায় সেই শোক যেন ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক। সেজন্যই হয়তো ‘হিমের রাতে’ কবিতায় হেমন্তের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিশ্বকবি রবি ঠাকুর লিখেছেন, “হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো/দীপালিকায় জ্বালাও আলো/জ্বালাও আলো/আপন আলো/সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে...”।

স্বভাবতই হেমন্তের শেষ দিকে কমে যায় বাতাসের আর্দ্রতা। চর্ম রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকাংশেই। আগাম সতর্কতাস্বরুপ ত্বককে চুলকানি, খোসপাঁচড়া ও স্ক্যাবিস রোগ থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন নিয়মিত পেট্রোলিয়াম জেলি ও ময়েশ্চারাইজারের ব্যবহার।

এরই মধ্যে প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে উত্তুরে বাতাসের হালকা কাঁপুনি। যে কাঁপুনি একসময় তীব্র হয়ে জানান দিবে শীতের উপস্থিতি। টনসিল ও সাইনুসাইটিস রোগীদের পোহাতে হবে চরম ভোগান্তি। বৃদ্ধ ও শিশুদের দিকে রাখতে হবে বাড়তি নজর। অপেক্ষাকৃত কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অবলম্বন করতে হবে বাড়তি সতর্কতা। নিজেকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পরিবারের বাকি সদস্যদের সুস্থতাও। 

 

আরপি/এসআর-০৪



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top