রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


মেডেল পাওয়ার গল্প


প্রকাশিত:
৭ নভেম্বর ২০১৯ ০০:১১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:০৫

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার, পিপিএম

১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস। আমি চাঁপাইনবাবঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানা থেকে বদলী সূত্রে নঁওগা জেলার সাপাহার থানায় যোগদান করি। থানাটি নঁওগা জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। থানার উত্তর দিকে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা যার দুরত্ব থানা থেকে ২ কিলোমিটার এবং পশ্চিমে মালদহ জেলা যার দূরত্ব থানা থেকে ৮ কিলোমিটার। আগে বর্ডারে এখনকার মত কাটা তারের বেড়া ছিল না ফলে দু দেশের লোকেরা অবাধে এপার ওপার যাতায়াত করতো। সাপাহার থানায় যোগদানের পর থানা এলাকায় বেশ কয়েকটি ডাকাতির কারনে আমি প্রশাসনিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। ডাকাতদের সনাক্ত পূর্বক তাদেরকে গ্রেফতার ও লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধারের জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট হতে কঠোর চাপ ও নির্দেশনা পাই। ডাকাতদের অধিকাংশই ভারতীয়। তারা বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে এসে স্থানীয় ডাকাতদের সাথে মিলে একত্রে ডাকাতি করে রাতারাতি ভারতে পালিয়ে যেত।

থানায় কর্মরত অফিসাররা মুন্না শেখ নামে একজন সোর্সের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। সোর্স হিসাবে সে অত্যন্ত পারদর্শী এবং অভিজ্ঞ। ডাকাতদের সনাক্ত করার জন্য মুন্না শেখকে ভারতে গিয়ে ছোটখাট কৌশল হিসেবে অপরাধ করে ইচ্ছাকৃতভাবে ধরা পড়ে জেলে যেতে বলি। উদ্দেশ্য জেলে বসে ডাকাতদের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা। কোন জায়গায় অপরাধ সংঘটিত হলে কারা তা করেছে জেলের অপরাধীরা তা জেলে বসেই সংবাদ পায়। অপরাধীরা সাধারণতঃ জেলে বসে বিভিন্ন জায়গায় অপরাধ করার জন্য পরিকল্পনা করে থাকে তাই আমার থানা এলাকায় কে কে ডাকাতি করে, ইতোপূর্বে তারা কোথায় ডাকাতি করেছে এবং ভবিষ্যতে কোথায় করবে, তাদের সংগে কোন কোন ভারতীয় এবং বাংলাদেশী ডাকাত রয়েছে ইত্যাদি তথ্য মুন্না শেখের মাধ্যমে জেল খানা থেকে সংগ্রহ করা অত্যন্ত জরুরী মনে করি। এ কারণে আমি আগেও তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে বিভিন্ন সময় সোর্সকে ফৌজদারী কার্যবিধি ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছি। পরবর্তীতে জামিন করে তাদের মাধ্যমে বিস্তারিত সংবাদ জেল খানা থেকে সংগ্রহ পূর্বক বিভিন্ন অপরাধীদের সনাক্ত এবং গ্রেফতার করে লুন্ঠিত ও চুরিকৃত মালামাল উদ্ধার, বিভিন্ন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেছি।

পরিকল্পনা মোতাবেক মুন্না শেখ কিছুদিন পর ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরে গিয়ে সাইকেল চুরি করার সময় স্থানীয় জনগণ কর্তৃক হাতেনাতে ধৃত হয়ে উত্তম মধ্যম মার খেয়ে জেলে যায়। সাত মাস জেলে থাকার পর জামিনে মুন্না শেখ বেরিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ ও ভারতের কে কে সাপাহার থানা এলাকায় ডাকাতি, দস্যুতা, চুরিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে তা বিস্তারিত ভাবে জানায়। মুন্না শেখ ডাকাতির জন্য ভারত থেকে কৌশলের মাধ্যমে ডাকাতদের বাংলাদেশে ডেকে এনে স্থানীয় ডাকাতদের সহ থানা এলাকায় বিভিন্ন বাড়ীতে ডাকাতি করার জন্য পরিকল্পনা করে এবং আমাকে জানিয়ে দেয়। তার দেয়া তথ্য মতে আমি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশ ও ভারতীয় ডাকাত ধৃত এবং ক্লু-লেস ডাকাতি মামলার রহস্য উদ্্ঘাটন করতে সক্ষম হই। যা প্রশাসনে এবং এলাকায় দারুণভাবে প্রশংসিত হয় ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

মুন্না শেখ কয়েকজন ভারতীয় ডাকাতকে দিনের বেলায় অস্ত্র সহ সাপাহার থানা সদরের একটি হোটেলে ডেকে আনে। আমি পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সাদা পোষাকে খদ্দর হিসাবে সে হোটেলে বসে থাকি। তারা হোটেলে আসা মাত্রই দুটি অস্ত্র এবং চার রাউন্ড গুলিসহ দু’জন ভারতীয় ডাকাতকে ধৃত করার সময় মুন্না শেখ পরিকল্পনা মোতাবেক আমাদেরকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। যাতে তার প্রতি কোন অপরাধী সন্দেহ পোষণ করতে না পারে। অপর একটি ঘটনায় মুন্না শেখের দেয়া তথ্য মতে আমি আমার থানা মসজিদের ইমাম যিনি একজন হাফেজও বটে তার কাছ থেকে ষ্টেনগান উদ্ধার করি। ডাকাতরা ডাকাতি করার পর তার কাছে ষ্টেনগানটি জমা রেখে দিত। থানা মসজিদের ইমাম বলে তাকে সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না। মুন্না শেখের দেয়া তথ্য মতে পত্নীতলা থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে শমসের ডাকাতকে ধৃত করে তার নিকট হতে গুলিসহ একটি বন্দুক উদ্ধার করি।

১৯৮৯ সালের ০১ অক্টোবর। সময় ১০.২৫ মিনিট। সকাল বেলায় আমি আমার অফিস কক্ষে বসে একটি চাঞ্চল্যকর ডাকাতি মামলার কেস ডাইরী লিখছি। এমন সময় থানার ওয়্যারলেস অপারেটর একটি বেতার বার্তা এনে আমাকে জানায় যে, গতকাল সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী পোরশা থানাধীন বাংধারা গ্রামের জনৈক নুরুল ইসলামের বাড়ীতে ডাকাতরা দুর্ধষ্য ডাকাতি করে বিভিন্ন মালামালের সাথে একটি একনলা বন্দুক লুট করে নিয়ে গেছে। বাড়ীর মালিক তখন মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন। আমি বিষয়টি জানার পর থানার উপস্থিত অফিসারদের আমার রুমে ডেকে ডাকাতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করি। কিভাবে ডাকাতদের সনাক্ত পূর্বক গ্রেফতার করে লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করা যায়, সে ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা তৈরী করে সে মোতাবেক কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নেই।


৪ঠা অক্টোবর সকাল ১০০০ ঘটিকা। আমি থানার অফিস কক্ষে বসে জরুরী ফাইল দেখছি। এ সময় সেন্ট্রি জানায়, মুন্না শেখ আমার সাথে দেখা করতে চায়। মুন্না শেখকে আমার কক্ষে আসার অনুমতি দিলে সে এসে জানায় ভারতীয় ডাকাতদের নিকট থেকে সে জানতে পেরেছে পত্নীতলা থানাধীন দক্ষিণ কাজীপাড়া গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত সরদার মোর্শেদুল তার দল বল নিয়ে গত ৩০ অক্টোবর সন্ধায় পোরশা থানাধীন বাংধারা গ্রামের একটি বাড়ীতে ডাকাতি করে একনলা বন্দুক সহ বিভিন্ন মালামাল লুন্ঠন করেছে। মোর্শেদুল বর্তমানে তার স্ত্রীসহ পত্নীতলা থানাধীন সোনাপুর গ্রামের একটি বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। এ খবর পেয়ে আমি ব্যাপারটি দ্রুত পত্নীতলা সার্কেল এএসপি জনাব মোঃ আব্দুল হালিম (পরবর্তীতে পুলিশ সুপার) কে অবহিত করি এবং তার নির্দেশ মোতাবেক সংগে এসআই মোঃ আনিছুরকে সহ পত্নীতলা থানার উদ্দেশ্য রওনা হই। পত্নীতলা থানায় পৌঁছে সার্কেল এএসপির নেতৃত্বে ওসি পত্নীতলা জনাব মোস্তফা কামাল এবং সংগীয় ফোর্সসহ আমি সোনাপুর গ্রামের উদেশ্যে রওনা হই। সেখানে পৌঁছে জানতে পারি যে মোরশেদুল তার স্ত্রী সহ একটি একনলা বন্দুক নিয়ে গতকাল রাত্রে ঐ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। অদ্য সকালে সে স্ত্রীসহ মহাদেবপুর থানাধীন হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে চলে গেছে।

এ খবর জেনে আমি কয়েকজন ফোর্সসহ দ্রুত হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে গিয়ে জনৈক রহিমুদ্দীনের বাড়ীতে ডাকাত মোরশেদুলের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হই। দেরী হলে পালিয়ে যেতে পারে বিধায় আমি কোন কিছু খেয়াল না করে এককভাবে এগিয়ে যায় এবং দেখি ডাকাত মোরশেদুল একটি নির্জন জায়গায় জঙ্গলের পার্শ্বে বাড়ীর পেছন দিকের খোলা বারান্দায় বসে আছে। এরপর আমি ঐ বাড়ীর পেছন দিকের খোলা বারান্দা থেকে নিজের জীবন বিপন্ন করে একক প্রচেষ্টায় ডাকাত মোরশেদুলকে আটক করি। আমি ডান হাত দিয়ে তার লুঙ্গি এবং বাম হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। ঐ সময় আমার সঙ্গে ডাকাত মোরশেদুলের দীর্ঘ ৫/৬ মিনিট ধরে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে ডাকাত মোরশেদুল আমার গলা চিপে ধরলে আমার অবস্থা মৃত্যু প্রায় হয়ে পড়ে এবং গলায় জখম হয়ে রক্ত পড়তে থাকায় আমি গুরুতর আহত হই। কিন্তু কৌশলে তাকে কাবু করতে সক্ষম হই। এসময় সেখানে অন্য কোন ফোর্স উপস্থিত ছিল না। তারা আমার নিকট থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। ইতোমধ্যে আমার চিৎকার শুনে কনষ্টেবল সাত্তার প্রথমে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ফোর্সরা ছুটে আসে।

আটকের পর মোরশেদুল বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের সামনে স্বীকার করে যে ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধায় ৭ জন সঙ্গীসহ সে পোরশা থানার বাংধারা গ্রামে জনৈক নুরুল ইসরামের বাড়ীতে ডাকাতি করে অন্যান্য মালামালের সাথে একটি একনলা বন্দুক লুন্ঠন করে। স্বাক্ষীদের উপস্থিতিতেই আসামী মোরশেদুল শোয়ার ঘর থেকে বন্দুক, তিনটি তাজা গুলি এবং তার ভাগে পাওয়া একটি সোনার চেন, দুইটি আংটি বের করে দেয়। স্বাক্ষীদের উপস্থিতিতে তা জব্দ করে নিজ হেফাজতে নেই। ডাকাত সর্দার মোরশেদুল আরও স্বীকার করে যে, সে আন্তঃ জেলা ডাকাত। ডাকাতরা তার নেতৃত্বে নঁওগা ও পার্শ্ববর্তী জেলার এ পর্যন্ত ২৫/৩০ টি ডাকাতি করেছে। ডাকাতির সময়ে কখনো কখনো সে বাড়ীর লোকজনকে হত্যা ও সুন্দরী মেয়েদেরকে ধর্ষন করেছে।

আসামী মোরশেদুলকে লুন্ঠিত উদ্ধারকৃত বন্দুক ও গুলি এবং অন্যান্য মালামালসহ পত্নীতলা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে দু হাত দিয়ে আমার গলাচিপে ধরার দরুন পুলিশ সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে মেরে তার বাম পা ভেঙ্গে দেয়ার সময় আমি তাকে না মারার জন্য অনুরোধ করি। তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব চৌধুরী এ,এ,জি কবির আমার এই সাহসী তৎপরতা এবং একক প্রচেষ্টায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকাত মোর্শেদুলকে গ্রেফতার, লুন্ঠিত বন্দুক ও গুলি উদ্ধারের জন্য আমাকে প্রশংসিত করেন। তাকে গ্রেফতারের পর ঐ এলাকায় জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। তার বিরুদ্ধে মহাদেবপুর থানায় অস্ত্র আইনেও একটি মামলা রুজু করা হয়। বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। পরের দিন এ খবর প্রায় প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে লীড নিউজ হিসাবে ছবিসহ ছাপা হয় যার কারণে আমি অনেকের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে থাকি।

আমি প্রতিটি থানায় একটি বোর্ড তৈরী করে সেখানে পেপার কাটিং লাগিয়ে রাখতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ডাকাত মোরশেদুলকে ধৃত ও অস্ত্র উদ্ধারের খবরগুলি কাটিং করে ঐ বোর্ডে লাগিয়ে রাখি। ডাকাত সর্দার মোরশেদুলের স্বীকারোক্তি এবং দেখানো মতে বর্ণিত মামলা ছাড়াও পূর্বের অনেক ডাকাতি মামলায় মোট ১৭ জন ডাকাতকে গ্রেফতার করে তাদের নিকট থেকে লুন্ঠনকৃত মালামাল উদ্ধার করি। তাদের গ্যাংটি ধরা পড়ায় এলাকায় ডাকাতি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং জনগণ রাত্রিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।
ঘটনার কয়েকদিন পর পুলিশ সুপার আমার থানা পরিদর্শনে এসে বোর্ডে পেপার কাটিং দেখে আমাকে পিপিএম পাওয়ার জন্য আবেদন করতে বলেন। আমি পরের দিন পেপার কাটিং সংয্ক্তু করে আবেদন পত্র প্রেরণ করি। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (যিনি পরবর্তীতে আইজি, মরক্কোর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে যুব মন্ত্রণালয়ের সচিব) জনাব নুর মোহাম্মদ আমাকে জানান যে, নিজের জীবন বিপন্ন করে অসীম সাহসিকতার সাথে ডাকাত সর্দার মোরশেদুলকে ধৃত এবং বন্দুক ও গুলি উদ্ধার করে বিরল কর্তব্যনিষ্ঠা, অতুলনীয় বীরত্ব ও অপরিসীম নৈপুণ্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের যে উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি তার স্বীকৃতি স্বরুপ সরকার আমাকে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনিত করেছেন। সংবাদটি অবহিত হয়ে আমি মহান আল্লাহর পাক এর নিকট শুকরিয়া আদায় করি।

মুন্না শেখের দেওয়া তথ্য মতে বিভিন্ন মামলায় একের পর এক ডাকাত ধৃত এবং অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় দেশী এবং ভারতীয় ডাকাতরা আমার এবং মুন্না শেখের উপর চরম ক্ষিপ্ত হয়। চ্যালেঞ্জ স্বরুপ নভেম্বর মাসের শেষ দিকে রাত ২ টার সময় সাপাহার থানায় আমার বাসভবন সংলগ্ন মান্নান শিকদারের বাসায় ডাকাতি করে যাওয়ার সময় আমার বাসার গেটে ককটেল ছুড়ে মারতে থাকে। ককটেল বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে দরজা ফাঁক করে ধোঁয়ায় আবছা ভাবে দেখি ১০/১৫ জন মুখোশধারী ডাকাত আমার বাসার গেটে ককটেল ছুড়ে মারছে। আমি পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার জন্য তাক করি। কিন্তু রেঞ্জের মধ্যে না পাওয়াতে গুলি করা যায় না। এ সময় থানা থেকে পাহারারত সেন্ট্রি কনস্টেবল সাদেক এবং মোস্তাফিজ তাদের রাইফেল নিয়ে ক্রলিং করে আমার বাসার সামনে আসে। সাদেক এর হাত থেকে রাইফেল নিয়ে আমি ডাকাতদের দিকে তাক করে ৪/৫ রাউন্ড গুলি করি। এ সময় কনষ্টেবল মোস্তাফিজুর রহমানও তার রাইফেল দিয়ে ৩/৪ রাউণ্ড গুলি করে। গুলি শুরু হলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। অনুমানিক ১০/১৫ মিনিট পর সামনে পরিস্কার হলে কাউকে দেখা যায় না। টেনশনে আমার গায়ে জ্বর আসে। একে তো আমার বাসভবন সংলগ্ন বাসায় ডাকাতি, তদুপরি আমার বাসভবনে ডাকাতদের দ্বারা ককটেল নিক্ষেপ এবং গুলি বর্ষনের মতো ঘটনা। রাত্রিতেই মান্নান শিকদারের বাসা পরিদর্শন করি।

পরিদর্শন কালে জানতে পারি, অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জন কালো মুখোশধারী ডাকাত তার বাড়িতে প্রবেশ করে পরিবারের সবাইকে মারপিট করে একটি ভি.সি.আর, নগদ ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা এবং কিছু স্বর্ণের অলংকার লুন্ঠন করে যাওয়ার সময় আমার বাড়িতে ককটেল হামলা চালায়। ইতোমধ্যে থানার অন্যান্য অফিসার ও ফোর্সরা ঘটনা স্থলে ছুটে আসে। জানতে পারি আমার বাসায় আক্রমণের সময় তাদের কেউ বাথরুমে, কেউ খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। অথচ এটা কাম্য নয়। তাদের উচিত ছিল আমার সাহায্যে এগিয়ে আসা কিন্তু তারা তা করেনি। বিষয়টি আমাকে কষ্ট ও ব্যথা দিয়েছে। টেনশনে জ্বর আসায় লেপ গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকি। খুব সকালে মোজাহার কনষ্টেবলের ছেলে (বর্তমানে কনষ্টেবল) এসে জানায়, আংকেল আপনার বাড়ীর সামনের দিকে আনুমানিক ৫০০ গজ দূরে ক্ষেতের মধ্যে ১টি লোকের মৃত দেহ পড়ে আছে। তার মুখে কালো মুখোশ, লুঙ্গি মালকোচা মারা, হাতে ১টি ব্যাগ, গলায় স্বর্নের চেন ইত্যাদি। ১০/১২ জন লোক সেখানে ভিড় জমিয়ে দেখছে। আরো লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসছে।

আমি সঙ্গীয় অফিসার ও ফোর্স সহ দ্রুত গতিতে সেখানে যাই এবং দেখি এক জনের মৃতদেহ পড়ে আছে। তার মুখে কালো মুখোশ, লুঙ্গি মালকোচা মারা, হাতে একটি ব্যাগ, গলায় স্বর্ণের চেইন, বাম হাতে দামী ঘড়ি। ইতোমধ্যে মান্নান শিকদার এবং আরও অনেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তাদের উপস্থিতিতে আমি ব্যাগ খুলে দেখি তার ভিতর লুন্ঠিত ভি.সি.আর এবং ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা। ডান হাতে ২টি স্বর্ণের চেইন এবং হাতে ঘড়ি। উপস্থিত স্বাক্ষীদের সামনে তা জব্দ করা হয়। মান্নান শিকদার টাকা, ভি.সি.আর, এবং স্বর্ণের চেইন ও ঘড়ি তার বলে সনাক্ত করে। ইতোমধ্যে ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানালে পুলিশ সুপার চৌধুরী এ,এ,জি কবির একজন ডাকাতকে গুলি করে মেরে তার নিকট থেকে লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারের জন্য আমাকে ভূয়শী প্রশংসা এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে থানা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব কামাল হোসেনকে লাশের সুরতহাল করার জন্য ঘটনাস্থলে প্রেরন করেন। উল্লেখ্য পুলিশের গুলিতে কেউ মারা গেলে নিয়মানুযায়ী ম্যাজিষ্টিট দ্বারা সুরতহাল করতে হয়।

এ ক্ষেত্রে থানা ম্যাজিষ্ট্রেট কামাল হোসেন ঘটনাস্থলে এসে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশের সহায়তায় নওগাঁ মর্গে প্রেরণ করেন। ময়না তদন্তের পর কোন দাবীদার না থাকায় লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে নওগাঁ শহরের গোরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করে দু জন কনষ্টেবল কে সাদা পোষাকে গোরস্থানে প্রেরণ করি। তারা দূর থেকে লক্ষ্য করতে থাকে কেউ লাশের কাছে আসে কিনা ? দাফনের আগে দুজন মহিলা লাশের কাছে এসে কাঁদতে থাকে। আমরা দাফন সম্পন্নের পর মহিলা দু জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি, মৃত ব্যক্তিটি একজন মহিলার স্বামী যার নাম খাতের আলী। তাদের বাড়ী নঁওগা জেলার ধামুইরহাট থানায়। আমরা বিষয়টি পুলিশ সুপার মহোদয়কে অবহিত করি এবং ধামুইরহাট থানায় যোগাযোগ করে জানতে পারি যে, খাতের আলীর নামে ঐ থানায় ডাকাতি মামলা সংক্রান্ত ১৬ টি গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। তার নামের মামলা সমূহে আর কে কে জড়িত তা জেনে আমারা পযার্য়ক্রমে অভিযান চালিয়ে মোট ১২ জন ডাকাতকে গ্রেফতার করি। তাদের নিকট হতে বর্ণিত মামলাসহ অন্যান্য ডাকাতি মামলার লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হই। বিষয়টি এলাকায় দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। ঐ ঘটনায় ৫ জন ভারতীয় ডাকাত জড়িত ছিল। তাদের অবশ্য ধরতে পারিনি, তারা ভারতে পালিয়ে যায়।

ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক। সন্ধার সময় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাসের নিরাপত্তা ডিউটি করার জন্য মহাদেবপুর থেকে নাটোর হয়ে পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হই। রাত্রিতে নাটোরে আমার বড় ভায়রা সদর সার্কেলের এএসপি জনাব মোঃ হামিদুল ইসলামের বাসায় অবস্থান করে পরের দিন পাবনার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। রাত ৮ টার সময় হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে বগুড়া হয়ে নাটোর যাওয়ার পথে দুপচাঁচিয়া থানা এলাকায় আমার মোটর সাইকেল স্লীপ করে আমি রাস্তার পার্শ্বে ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত লাগার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। তখন আমার পরনে ইউনিফর্ম এবং কোমরে পিস্তল লাগানো ছিল। আমার মাথায়, দু হাতের কনুইয়ে এবং পায়ের হাঁটুতে জখম হয়। আনুমানিক ৩০ মিনিট পড়ে থাকার পর ধুপচাঁচিয়া থানার সান্ধ্যকালীন টহল পুলিশ আমাকে দেখে থানার ওসিকে অবগত করে ধুপচাঁচিয়া থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। আমার পকেটে থাকা কাগজপত্র দেখে তারা আমার পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারেন যে, আমি মহাদেবপুর থানার ওসি। আনুমানিক ৫০ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে এলে আমি কর্তব্যরত ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করি, আমি কে, কি আমার পরিচয় ? হেড ইনজুরির কারণে কোন ঝুঁকি না নিয়ে তারা আমাকে বগুড়া হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করেন এবং পুলিশ সুপার নঁওগা, বগুড়া ও নাটোরকে আমার দূর্ঘটনার খবর দুপচাঁচিয়া থানার মাধ্যমে বেতারযোগে জানান।

পুলিশ সুপার নঁওগা জনাব হাজী রুহুল আমিন তখন সারদা পুলিশ একাডেমীতে ট্রেনিং এ ছিলেন। সংবাদ অবগত হয়ে তিনি নঁওগা থেকে একটি জীপ, পুলিশ সুপার বগুড়া একটি এম্বুলেন্স প্রেরন করেন। নাটোরের পুলিশ সুপারের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে আমার ভায়রা নাটোর সদর সার্কেল এএসপি একটি প্রাইভেটকার সহ দুপচাঁচিয়ায় আসেন। এ্যাম্বুলেন্স যোগে আমাকে বগুড়া হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওয়ার্ডে জায়গা না পাওয়ায় মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়। হাসপাতালের অবস্থা দেখে আমার ভায়রা ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে আমাকে নাটোরে তার সরকারী বাসায় নিয়ে প্রাইভেট ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করান। সাতদিন পর চিকিৎসারত অবস্থায় আমাকে জানানো হয় ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে অনুষ্ঠিতব্য পুলিশ সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক প্রদান করা হবে। তাই আমাকে প্রস্তুতি মূলক প্যারেডে অংশ গ্রহণের জন্য এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় যেতে হবে।

আমি অসুস্থ অবস্থায় ২৬/১২/১৯৯১ তারিখে মহাদেবপুর থানায় গিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে পায়ে ব্যান্ডেজ অবস্থায় ঐ দিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং পরের দিন ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠে অনুশীলন প্যারেডে অংশগ্রহণ করি। দু’হাটুতে রক্তক্ষরণ হলেও আমি দু’পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে রক্ত আটকিয়ে রাখতাম। খুবই কষ্ট হতো কিন্তু কোন উপায় ছিল না। অবশেষে ২রা জানুয়ারি ১৯৯২ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমি রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক গ্রহণ করি। আমার জীবনে এটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কয়েক বছর পর আমি নঁওগা কোর্টে অস্ত্র মামলায় ডাকাত মোরশেদুল এর বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য প্রদান করি। ইতোমধ্যে অস্ত্র মামলায় তার ১০ বছর সাজা হয়। বাকী ডাকাতি মামলাগুলি তখনও বিচারাধীন। স্বাক্ষ্য প্রদানের সময় ডাকাত সর্দার মোরশেদুল এর সাথে আমার কথা হয়। আলাপ কালে তারকৃত অপরাধের জন্য সে অনুতপ্ত বলে জানায়। ফোর্সরা তাকে আদালত থেকে জেলে নেওয়ার সময় সে আরও বলে, স্যার জীবনে হয়তো আপনার সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। তাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আমার জন্য দোওয়া করবেন, আমি যেন জেল থেকে বের হয়ে ভাল মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারি। আমি স্ত্রী ছেলে মেয়ে সহ সৎভাবে জীবন যাপন করতে চাই। সে আরও জানায় তার দু ছেলে এক মেয়ে। সে কখনো চায় না তার ছেলেরা তার মতো অপরাধী হোক। এই বলে সে খুড়িঁয়ে খুড়িঁয়ে হেটে চলে যায়। এ সময় তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।

ডাকাত মোরশেদুলের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবি, জানিনা বিভিন্ন বিচারাধীন মামলায় তার কত দিন সাজা হবে। তবে এটা সত্য যে খুব সহজে সে জেল থেকে বের হতে পারবে না। কারণ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে একাধিক ডাকাতি ও খুনসহ ডাকাতি মামলা বিচারাধীন। বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ফাঁসীঁ হতে পারে। ডাকাত সর্দার মোর্শেদুল নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত। কিন্তু সময় ফুঁরিয়ে যাচ্ছে। মোর্শেদুল তার কৃত অপরাধের জন্য জেলে সাজা খাটবে। আর সন্তানেরা তার অবর্তমানে মানুষ হতে পারবে কি? সমাজ পতিরা কি সে সুযোগ দিবে, বুঝি না কেন এমন হয় ? নিয়মানুযায়ী প্রতিটি ঘটনার জন্য আলাদা মেডেল পাওয়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সব ঘটনা মিলিয়ে আমাকে একটি “রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক” দেওয়া হয়। এ পদকের জন্য আমি আজীবন মাসে এক হাজার টাকা পদক ভাতা হিসাবে পেয়ে থাকি। টাকা বড় কথা নয় বরং মেডেল পাওয়াতে আমি চাকুরীর সাথে সাথে সামাজিকভাবে যে সম্মান, আত্মতৃপ্তি পেয়েছি তা বলে বুঝানো যাবে না। যা আমার জীবনে জাগ্রত ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরপি/ এআর

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top