রাজশাহী শুক্রবার, ২১শে মার্চ ২০২৫, ৭ই চৈত্র ১৪৩১


আত্মার অমরত্ব: ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার চিরন্তন ভিত্তি


প্রকাশিত:
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:১৩

আপডেট:
২১ মার্চ ২০২৫ ০১:০৮

রাজশাহী পোস্ট

একটি মানুষের প্রকৃত ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয় তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও কর্মের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান সমাজে এই ধারণা যেন উল্টে গেছে। এখন একজন মানুষ কত ভালো, তা নির্ধারিত হয় তার পেশা ও উপার্জনের ভিত্তিতে। বিশেষত বিয়ের প্রসঙ্গে এটি প্রকটভাবে দেখা যায়। মেয়ের পরিবার ছেলের চরিত্র, নৈতিকতা বা চিন্তাভাবনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তার চাকরি ও সম্পদের ওপর। ফলে এমন অনেক বৈষম্যমূলক এবং অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে, যা সামাজিকভাবে হাস্যকর ও অযৌক্তিক।

অনেক শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, যাদের কাছ থেকে সমাজ উন্নত মানসিকতা আশা করে, তারাই কখনো কখনো নিজের মেয়ের বয়সি বা ছাত্রীর বয়সি মেয়েকে বিয়ে করে। এটি কেবল বয়সের পার্থক্যের বিষয় নয়, বরং মানসিকতা ও নৈতিক অবস্থানের প্রশ্ন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু যখন ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক স্বচ্ছলতা কাজে লাগিয়ে এ ধরনের অসম সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়, তখন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তা সত্ত্বেও অনেক অভিভাবক শুধুমাত্র ছেলের উচ্চপদস্থ চাকরি ও সম্পদের কারণে এসব বিষয় উপেক্ষা করে।

এর ফলে সমাজে একটি ভ্রান্ত বার্তা ছড়িয়ে পড়ে—অর্থ ও ক্ষমতা থাকলেই সব কিছু বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু একজন ভালো মানুষ শুধুমাত্র তার চাকরি বা টাকার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। প্রকৃত ভালো মানুষ সেই, যার নৈতিকতা আছে, যে সম্পর্কের মূল্য বোঝে এবং যে ক্ষমতার অপব্যবহার না করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানে। সমাজে এই চিন্তাধারা পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে নৈতিক অবক্ষয় আরও বাড়বে, যেখানে মানুষ তার মূল্যায়ন পাবে শুধুমাত্র পেশা ও সম্পদের ভিত্তিতে, চরিত্রের ভিত্তিতে নয়।

আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারণা, যা প্রায় সব ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের মৃত্যু কেবল দেহের শেষ, কিন্তু আত্মা চিরকাল জীবিত থাকে এবং মৃত্যুর পরও তার অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে। আত্মার এই নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্বকে কেন্দ্র করেই পরকাল, পুনর্জন্ম, স্বর্গ-নরক, কর্মফল ও ন্যায়বিচারের ধারণা গড়ে উঠেছে। মানুষের নৈতিকতা ও আচরণের ওপর আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসের গভীর প্রভাব রয়েছে। কারণ, যদি কেউ জানে যে তার কর্মের প্রতিফল মৃত্যুর পরও তাকে বহন করতে হবে, তবে সে অন্যায় করা থেকে বিরত থাকবে এবং সৎ পথে চলতে চেষ্টা করবে।

আত্মার অমরত্বের ধারণা ন্যায়বিচারের একটি প্রতীক। বাস্তব জীবনে আমরা প্রায়ই দেখি, ভালো মানুষ অবিচারের শিকার হয়, আর অন্যায়কারী শাস্তি এড়িয়ে চলে। কিন্তু আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস মানুষকে এই আশ্বাস দেয় যে প্রকৃত বিচার মৃত্যুর পর হবে, যেখানে কেউই অন্যায়ের শাস্তি এড়াতে পারবে না। এটি মানুষের মনে নৈতিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে এবং তাকে সৎ ও মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করে।

এই বিশ্বাস কেবল ধর্মীয় নয়, বরং মানসিক শান্তিরও একটি উৎস। যখন মানুষ জানে, তার অস্তিত্ব কেবল দেহের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ নয়, তখন সে মৃত্যুকে ভয় পায় না এবং জীবনকে অর্থপূর্ণভাবে পরিচালনা করতে পারে। আত্মার অমরত্বের ধারণা ব্যক্তিকে জীবনের গভীর তাৎপর্য অনুধাবনে সহায়তা করে, যা তাকে ভালো কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত করে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত করে।

পৃথিবীতে ন্যায়বিচার সবসময় তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে না। আমরা প্রায়ই দেখি, অনেক ভালো মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেও কষ্ট ভোগ করছে, অবহেলা, তিরস্কার ও অন্যায়ের শিকার হচ্ছে। আবার অনেক দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, প্রভাব-প্রতিপত্তির শীর্ষে রয়েছে। তাহলে কি সত্যিই ভালো কাজের ফল পাওয়া যায়? না কি অন্যায় করলেই সাফল্য নিশ্চিত? এই প্রশ্নগুলো যুগে যুগে মানুষের মনে দোলা দিয়েছে। কিন্তু তারপরও পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা কমে যায়নি। মানুষ কীসের ভরসায় সৎ ও ন্যায়পরায়ণ থাকার চেষ্টা করে?

এর সবচেয়ে বড় কারণ পরকালের প্রতি বিশ্বাস। প্রায় সব ধর্মেই বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর এক নতুন জীবন অপেক্ষা করছে, যেখানে মানুষের সমস্ত কর্মের বিচার হবে। যারা ভালো কাজ করেছে, তারা পুরস্কৃত হবে, আর যারা অন্যায় করেছে, তারা শাস্তি পাবে। এই বিশ্বাস মানুষকে সংযত রাখে, অপরাধ থেকে দূরে রাখে এবং সৎপথে চলতে উৎসাহিত করে। কারণ, পার্থিব জীবনে অন্যায়কারীরা সাময়িক লাভবান হলেও চিরস্থায়ী দণ্ড তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই নৈতিকভাবে দৃঢ় মানুষ জানে, পৃথিবীতে সাময়িক ক্ষতি হলেও, প্রকৃত বিচারের দিন আসবে।

আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস মানুষের জন্য অপরিহার্য। কারণ, মৃত্যুই শেষ নয়; বরং এটি আরেকটি জীবনের সূচনা। একজন মানুষ যে বিশ্বাস করে তার আত্মা চিরকাল বেঁচে থাকবে এবং তার কর্মফল তাকে মৃত্যুর পরও অনুসরণ করবে, সে সহজে অন্যায় করতে পারে না। সে জানে, হয়তো পৃথিবীতে সে ন্যায়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু পরকালে সে ন্যায়বিচার পাবে। এই বিশ্বাসই মানুষকে সৎ রাখতে সহায়তা করে।

এজন্যই বলা হয়, ভালো কাজ কেবল পার্থিব লাভের জন্য নয়, বরং তা আত্মার শুদ্ধতার জন্যও জরুরি। কেউ যদি শুধুমাত্র দুনিয়াতে ভালো ফল পাওয়ার আশায় সৎ জীবনযাপন করে, তবে অন্যায়ের সাফল্য দেখে সে হতাশ হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু যদি সে জানে যে তার কর্মফল চিরস্থায়ী এবং একদিন সে এর প্রকৃত প্রতিদান পাবে, তাহলে সে ধৈর্যশীল থাকবে। ভালো মানুষ তাই শুধু নিজের জীবনকেই সুন্দর করে না, বরং সমাজের জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

পরকালের প্রতি বিশ্বাস সমাজে ন্যায় ও সততার ভিত্তি রচনা করে। এটি যদি মানুষ ভুলে যায়, তাহলে পৃথিবী শুধু স্বার্থপরতা, লোভ ও অন্যায়ের হাতে চলে যাবে। মানুষ তখন আর ভালো কাজের জন্য উৎসাহী থাকবে না। তাই আত্মার অমরত্ব ও পরকালের ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার এক শক্তিশালী মাধ্যম, যা সমাজকে অপরাধমুক্ত, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবিক করে তোলে।

 

হালিমা আক্তার হানী
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ
সহযোগী সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি

 

আরপি/আআ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top