রাজশাহী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৮ই বৈশাখ ১৪৩১


নওগাঁ বেস ষ্টেশনের বেতার চালক ভুল শুনে পুলিশ সুপার নওগাঁকে দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যুর খবর প্রচার করে


প্রকাশিত:
২ নভেম্বর ২০১৯ ২১:৫৯

আপডেট:
২ নভেম্বর ২০১৯ ২২:০১

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

অনেক সময় মানুষ ডাকাতের কবলে পড়ে কিংবা ডাকাত পুলিশের। কিন্তু পুলিশ যে ডাকাতের কবলে পড়ে সে কথা হয়তো অনেকেরই অজানা। ওসি হিসেবে দীর্ঘ ২৬ বছর চাকরীর সময় আমি চার বার ডাকাতের কবলে পড়েছিলাম।

চার বারের মধ্যে প্রথমবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একক প্রচেষ্টায় ডাকাতের আস্তানায় প্রবেশ করে প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তির পর সশস্ত্র ডাকাতকে ধৃত পূর্বক লুন্ঠিত এক নলা বন্দুক ও মালামাল উদ্ধার এবং ডাকাতির রহস্য উদঘাটন করে পুরা গ্যাংকে সনাক্ত পূর্বক ধরতে সক্ষম হই। তাকে ধরার সময় আমাকে মেরে ফেলার জন্য সে আকম্মিকভাবে আমার গলা টিপে ধরে। কিন্তু হাতাহাতির একপর্যায়ে কৌশলে আমি তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হই। দ্বিতীয়বার ডাকাতি করে ডাকাতরা পালিয়ে যাবার সময় আমার সরকারী বাসভবনে ককটেল হামলা চালানোর সময় একজন ডাকাতকে গুলি করে মেরে সমস্ত লূন্ঠিত মালামাল উদ্ধার এবং মামলার সহিত জড়িত সকল আসামিদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। এজন্য আমাকে “রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকে” ভুষিত করা হয়। বাকী দু’বার আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়। এমন কি আমার মৃত্যুর খবর পর্যন্ত থানায় আসে।


১৯৮৯ সালের ৪ অক্টোবর বেলা ৩টার সময় নওগাঁ জেলার সাপাহার থানার ওসি হিসেবে কর্মরত থাকাকালে গোপন সূত্রে সংবাদ পাই যে, পাশের পত্নীতলা থানাধীন দক্ষিণ কাজী পাড়া গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত মোরশেদুল পোরশা থানাধীন বাংধারা গ্রামের জনৈক নুরুল ইসলামের বাড়ি থেকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার সময় একটি বন্দুক ডাকাতি করে নিকটবর্তী মহাদেবপুর থানার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে।

এই সংবাদ পাওয়া মাত্র বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আমি কিছু সংখ্যক পুলিশ ফোর্স সঙ্গে নিয়ে দ্রুত সেখানে যাই এবং বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলি। অতঃপর আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একক প্রচেষ্টায় ডাকাতের আস্তানায় প্রবেশ করে সশস্ত্র ডাকাত মোরশেদুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ৫/৬ মিনিট প্রবল ধ্বস্তাধস্থির পর তাকে ধরাশায়ী করি । এই সময় ডাকাত মোরশেদুল আকস্মিকভাবে আমার গলা টিপে ধরে এবং আমাকে প্রায় মেরে ফেলার উপক্রম করে। কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সৌভাগ্যক্রমে হাতাহাতির লড়াইয়ে তাকে পরাস্ত করে নিজের জীবন রক্ষা এবং লুন্ঠিত একনলা বন্দুক ও তিনটি তাজাগুলি সহ ডাকাত মোরশেদুলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।

পরের দিন প্রায় সকল জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় এতদসংক্রান্তে খবর গুরুত্ব সহকারে ফলাও করে ছাপা হয় এবং বিষয়টি ব্যাপক চাঞ্চ্যল ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম ঘটনা।


১৯৯০ সালে নওগাঁ জেলার সাপাহার থানায় ওসির দায়িত্ব পালনের সময় ১৫/১৬জন ডাকাত গ্রেফতার এবং ৫টি বন্দুক ও ২৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের কারণে ডাকাতরা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার সরকারী কোয়ার্টার সংলগ্ন জনৈক আব্দুল মান্নানের বাড়ীতে রাত্রিতে ডাকাতি করে। ডাকাতরা ডাকাতি করে যাবার সময় আমার কোয়ার্টারের মেইন গেটে অনবরত ককটেল মারতে থাকে। ককটেল ফাটার শব্দে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে ধোঁয়ার মধ্যে মুখোশধারী ডাকাতদের দেখি। ডাকাতদের এ ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আমার স্ত্রী শেফালী এবং আড়াই বছর বয়সের কন্যা উর্মি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ডাকাতরা রেঞ্জের মধ্যে না থাকায় পিস্তল দ্বারা গুলি করা যাচ্ছিল না।

এ সময় ককটেলের আওয়াজে অফিসাররা না এলেও কর্তব্যরত সেন্ট্রি সাদেক এবং মোস্তাফিজুর নিজ নিজ রাইফেল সহ ক্রলিং করে আমার কোয়ার্টারে ছুটে আসে। আত্মরক্ষার্থে কনষ্টেবল মোস্তাফিজুর রহমানের হাত থেকে রাইফেল নিয়ে ডাকাতদের উপর গুলিবর্ষন করি। কনষ্টেবল সাদেকও কয়েক রাউন্ড গুলি করে। আমাদের গুলিতে খাতের আলী নামে একজন মুখোশধারী ডাকাত নিহত হয়। তার কাছে লুন্ঠিত টাকা এবং মালামাল পাওয়া যায়। পরে মামলা সংক্রান্ত জড়িত সকল ডাকাতকে ধৃত করে তাদের নিকট হতে লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করি । আমার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক পাওয়ার ৬টি ঘটনার মধ্যে ডাকাতকে মেরে লুন্ঠিত মালামাল ও বন্ধুক উদ্ধারের ঘটনা অন্যতম। পরে জেনেছিলাম আমার বাসায় আক্রমণের সময় কর্মরত দুই অফিসারের মধ্যে একজন অফিসার ওয়াসরুমে এবং অপরজন খাটের নিচে পালিয়েছিল।

১৯৯১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানা থেকে বদলীসুত্রে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার ওসি হিসেবে যোগদান করি। এই থানায় চাকরী করাকালীন ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের আগমন উপলক্ষে পাবনায় ডিউটি পড়ে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সন্ধার সময় পুরা পোশাকে অস্ত্রসহ মটর সাইকেলে একাই মহাদেবপুর থেকে বগুড়া হয়ে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। রাত্রিতে নাটোরে আমার ভায়রা সদর সার্কেল এএসপি মোঃ হামিদুল ইসলামের বাসায় অবস্থান করে পরেরদিন সকালে পাবনায় রওয়ানা হওয়ার নিদ্ধান্ত নেই।

বিকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আকাশ মেঘলা এবং চারিদিকে অন্ধকার, মাঝে মাঝে বৃষ্টির চোখ রাঙ্গানী। বৃষ্টির সময় আমি থেমে থেমে যাচ্ছিলাম। শান্তাহার-বগুড়া রোডে ডাকাতরা প্রায়ই মোটর সাইকেল ছিনতাই করে থাকে। এমন প্রতিকুল আবহওয়া সত্ত্বেও কোন সংকোচ না করে দুপচাঁচিয়া রোড দিয়ে যেতে থাকি। একেতো পুলিশ অফিসার, তদুপরি সঙ্গে অস্ত্র রয়েছে। সে জন্য আমি নিশ্চিন্তে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলাম। ডাকাতরা রাস্তায় ডাকাতি করে মোটর সাইকেল ছিনতাই করার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক রাস্তার দু’পাশে গাছের সঙ্গে রশি বেঁধে রাখে। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।


রাত ০৮.১৫ মিনিটে বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া থানা এলাকার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতদের বাঁধা রশি লেগে আচমকা মোটর সাইকেল সহ ছিটকে মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকি। আমার মুখমন্ডল এবং দু’হাতের কনুই ও পায়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হয়। ঠোটের উপরে এবং নিচে বেশ কয়েকটি জায়গায় সেলাই দিতে হয়। হেলমেট থাকার জন্য বড় ধরণের দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। মুখোশধারী ডাকাতরা আমার দিকে এগুতে থাকে। পরে শুনেছি, ঐ সময় পিছন দিক থেকে একটি ট্রাক বগুড়ার দিকে যাচ্ছিলো। ড্রাইভার সহ ট্রাকে থাকা লোকজন ট্রাকের আলোতে হঠাৎ আমাকে মোটর সাইকেল সহ পড়ে যেতে এবং মুখোশধারী ১০/১২ জন ডাকাতকে আমার কাছে আসতে দেখে দ্রুত এসে ডাকাত, ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকে। তাদের চিৎকারে কিছু দূরে থাকা টহল পুলিশ তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে এসে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় অস্ত্র সহ মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় আই.ডি কার্ড ও পকেটে থাকা অন্যান্য কাগজপত্র দেখে আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। টহল পুলিশকে দেখে ডাকাতরা পালিয়ে যায়।

ঘটনাটি ওয়্যারলেছে ওসি দুপচাঁচিয়া কে জানিয়ে তারা আমাকে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সংবাদ পেয়ে ওসি দুপচাঁচিয়া আমার গুরুতর আহত হওয়ার খবর তাৎক্ষনিক ওয়্যারলেছে পুলিশ সুপার বগুড়া এবং নওগাঁকে অবহিত করেন। সংবাদ পেয়ে পুলিশ সুপার বগুড়া আমাকে বগুড়া হাসপাতালে নেওয়ার জন্য এ্যাম্বুলেন্স পাঠান। এদিকে নওগাঁ বেস ষ্টেশনের বেতার চালক ভুল শুনে পুলিশ সুপার নওগাঁকে দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যুর খবর জানান। মৃত্যুর খবর পেয়ে পুলিশ সুপার নওগাঁ এবং নাটোরে চাকুরীরত ভায়রাকে পুলিশ সুপার নাটোরের মাধ্যমে জানিয়ে আমার ডেডবডি নেওয়ার জন্য দুপচাঁচিয়া হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স পাঠান।

এদিকে মৃত্যুর খবর শুনে ভায়রা তার বাসায় অবস্থানরত আমার স্ত্রী শেফালি এবং অন্যান্যদেরকে কিছু না বলে ডেডবডি নেওয়ার জন্য দুপচাঁচিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আমার স্ত্রী পূর্ব থেকেই জানতেন, আমি মহাদেবপুর থেকে মোটর সাইকেল যোগে বগুড়া হয়ে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। তাই ভায়রাকে মন খারাপ অবস্থায় জরুরীভাবে গাড়ী নিয়ে বগুড়া যেতে দেখে আমার স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করেন। কিন্তু আমার ভায়রা তাকে কিছুই বুঝতে দেন না। আমার মেয়ে উর্মির বয়স তখন চার বছর। মাকে কাঁদতে দেখে সেও কাঁদা শুরু করে।


ইতোমধ্যে এ্যাম্বুলেন্সে আমাকে বগুড়া হাসপাতালে নেওয়া হয়। অনুমান ঘন্টাখানে পরে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসার পরে আমার প্রথম কথা ছিল আমি কে, এখানে কেন? হেড ইনজুরির কারনে এমনটি হয়েছিল বলে ডাক্তার জানান। এর মধ্যে ওয়্যারলেছে পুলিশ সুপার নওগাঁ এবং ভায়রাকে আমার জ্ঞান ফেরার কথা জানানো হয়। আমি বেঁেচ আছি জেনে তারা খুবই খুশী হন। আনন্দে আমার ভায়রা হামিদ ভাই কেঁদে ফেলেন। অনুমান একঘন্টা পর হামিদ ভাই বগুড়া হাসপাতালে এলে তাকে দেখে আমি কেঁদে ফেলি। ডাকাতের কবলে পড়ে আমাকে প্রায় এক মাস বিছানায় থাকতে হয়।


১৯৯৩ সালে নাটোর জেলার সিংড়া থানা থেকে বদলী সূত্রে গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থানার ওসি হিসেবে যোগদান করি। পলাশবাড়ী থানায় খুবই ডাকাতি হয়। এ ধরনের একটি ডাকাতি মামলা তদন্তকালীন সময়ে জানতে পারি, মামলার সাথে জড়িত এক ডাকাত গ্রেফতার হয়ে দিনাজপুর জেলার কতোয়ালী থানা হাজতে আটক রয়েছে। আরও জানতে পারি ওই ডাকাত আন্তঃজেলা ডাকাতদলের সদস্য। তার বিরুদ্ধে আশে পাশে জেলার বিভিন্ন থানায় একাধিক ডাকাতি মামলা রয়েছে। তাকে পলাশবাড়ী থানার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকৃত ডাকাতি মামলার রহস্য উৎঘাটন, এই মামলার সাথে কারা কারা জড়িত তা জানা এবং লূন্ঠিত মালামাল উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেই।


পুলিশ সুপার মহোদয়কে জানালে তিনি দিনাজপুর কতোয়ালী থানায় যেয়ে ধৃত ডাকাতকে পলাশবাড়ী থানার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে আনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি পুরাপোশাকে অস্ত্রসহ কনষ্টেবল মতিয়ারকে নিয়ে দুপুরে মোটর সাইকেলে ঘোড়াঘাট থানা হয়ে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। বিকালে দিনাজপুর কতোয়ালী থানায় পৌঁছে ধৃত ডাকাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করি। আসামীকে পলাশবাড়ী থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের নিমিত্তে বর্ণিত মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের জন্য আদালতে আবেদন দাখিল করি।


দিনাজপুর শহরে আমার বাড়ী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে না গিয়ে হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে সন্ধ্যা ৮.০০টার সময় পুনরায় মটরসাইকেলে দিনাজপুর থেকে ঘোড়াঘাট হয়ে পলাশবাড়ী থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। রাস্তায় একটি ট্রাকের সাথে আমাদের ৪/৫ বার ক্রসিং হয়। পরে জেনেছি একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যরা সম্মেলন শেষে দিনাজপুর থেকে ওই ট্রাকে করে ঘোড়াঘাট ফিরছিলেন। অন্ধকার পক্ষ হওয়ায় ডাকাতরা মোটর সাইকেল ডাকাতি করার জন্য কনট্রাকটর কর্তৃক কাঁটা রাস্তা আরো বড় করে কেটে গর্ত বানিয়ে রাখে। কেউ যেন বুঝতে না পারে সেজন্য গর্তের উপর গাছের পাতা বিছিয়ে রেখে দুরে দাঁড়িয়ে থাকে। মোটর সাইকেল যাবার সাথে সাথে খালে আটকে গেলে মারপিট করে ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

আমি কনষ্টেবল মতিয়ারকে পিছনে বসিয়ে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ঘন্টায় ১০০ মাইল বেগে মোটর সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম। রাস্তাটি সরু হলেও চলাচলের জন্য খুবই উপযোগী। ০৯.৫০ মিনিটের সময় রাস্তায় গাছের পাতা পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে না পেরে জোরে টান মারি। হঠাৎ মোটর সাইকেল গর্তে আটকে গিয়ে আমি ২/৩ হাত উচুঁতে উঠে ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। এ সময় আমার হাত-পা মুখের চামড়া ছিলে রক্তপাত হতে থাকে। হেলমেট থাকার কারণে আল্লাহর অশেষ রহমতে পুনরায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাই। সঙ্গে থাকা কনষ্টেবল মতিয়ার মাটিতে পড়ে প্রায় এক মিনিটের মতো অজ্ঞান থাকে।

পরে জেনেছি জ্ঞান ফেরার পর কনষ্টেবল মতিয়ার দেখে ১০/১২ জন মুখোশধারী ডাকাত দুর থেকে টর্চ লাইট মেরে আমাদের গায়ে পুুলিশের পোষাক দেখে কাছে আসার সাহস পাচ্ছিলনা। ডাকাতরা কাছে এসে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। এই ভেবে মতিয়ার আমার দেহ কাঁধে নিয়ে বাঁশী বাজাতে বাজাতে পালাতে থাকে। এদিকে দুর থেকে সেই ক্রসিং করা ড্রাইভার এবং গাড়ীতে থাকা ২০/২৫ জন ছাত্র ট্রাকের আলোতে দেখে রাস্তায় একটি মোটর সাইকেল পড়ে আছে, সেখানে ১০/১২জন মুখোশকারী ডাকাত মোটর সাইকেলটি তোলার চেষ্টা করছে। কিছু দুরে একজন পুলিশ আরেক পুলিশকে কাঁধে নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাকের লোকজন আমাদেরকে চিনতে পারে। কারন তাদের ট্রাকের সাথে আমাদের বেশ কয়েকবার ক্রসিং হয়েছে।


তারা ট্রাকের উপর থেকেই একযোগে ডাকাত, ডাকাত বলে চীৎকার করে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে আসে। ট্রাকের লোকজনকে দেখে মুখোশধারী ডাকাতরা মোটর সাইকেল রেখেই পালিয়ে যায়। ট্রাকের লোকজনকে দেখে মতিয়ার দ্রুত আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় এনে পরিচয় জানিয়ে ছাত্রদের সহায়তায় মোটর সাইকেলসহ গাড়ীতে তুলে ঘোড়াঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত নার্স পরীক্ষা করে ভুলবশতঃ জানান যে, আমি মারা গেছি। শুনে কনষ্টেবল মতিয়ার কাঁদতে কাঁদতে স্থানীয় টেলিফোন অফিসে যেয়ে পুলিশ সুপারকে আমার মৃত্যুর সংবাদ জানায়।


পুলিশ সুপার রাতেই পলাশবাড়ী থানায় আমার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে থানাস্থ সরকারী কোয়ার্টারে বসবাসরত আমার স্ত্রীকে না জানানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। আমার ডেডবডি আনার জন্য তিনি রাতেই গাইবান্ধা সদর সার্কেল এএসপি কে ঘোড়াঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান। সংবাদ পেয়ে কর্তব্যরত ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে দেখেন যে, আমি বেঁচে আছি। অনুমান ৪০মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। টি এন্ড টির মাধ্যমে পুলিশ সুপারকে মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে আমাকে বেঁচে থাকতে দেখে কনষ্টেবল মতিয়ার আনন্দে কেঁদে ফেলে এবং পুনরায় টেলিফোন অফিসে যেয়ে আমার বেঁচে থাকার সংবাদ পুলিশ সুপারকে জানায়।

এবারও আমাকে ডাকাতের কবলে পড়ে প্রায় একমাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। হাত-পা, শরীর এবং মুখমন্ডলে জখম ও সেলাইয়ের দাগ সারাজীবন আমাকে ডাকাতের কবলে পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ডাকাতদের কবলে পড়ার ঘটনা কোন দিন ভুলবোনা। বরং স্মৃতিতে চিরঅম্লান ও স্মরনীয় হয়ে থাকবে। বিশেষ করে শরীরের ক্ষত চিহ্নগুলি এখনও ঘটনার কথা স্মরন করিয়ে দেয়।


 

আরপি/এমএইচ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top