রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


অনৈতিক কর্মের দুটি ভিডিও নিয়ে তোলপাড়


প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২১ ০১:০৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৬:৪৭

প্রতীকি ছবি

নিকষ কালো অন্ধকারে বা ঘরের নিভৃত কোনে নিতান্তই লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটা কোনো অনৈতিক কর্ম ভিডিও প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে যখন জনসম্মুখে এসে পড়ে- তখন সমাজে থাকা কিছু লোক দুই ধরনের কর্ম করে।

প্রথমত ওই ভিডিওচিত্র নিয়ে কিছু লোক ঘটনার শিকার নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত কিংবা কৌশলে তার দুর্বল স্থানে আঘাত করে নিজেও এর ভাগিদার হতে চায়। আবার কিছু লোক সেই ভিডিও ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়ে প্রতারণা বা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পাতে।

অপকর্মকারী অর্থ-বৈভবের মালিকরা অর্থ দিয়ে ওই ঘটনা থেকে মুক্তি বা কৌশলে আইনের আশ্রয় নিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নিগৃহীত হয় ওই নারী। তাকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে তার সর্বস্ব লুটে নেয়া ছাড়াও তাকে সমাজে নষ্টা বলে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে সুবিধাভোগী চক্র। হয়তো বা শেষপর্যন্ত এসব নারীকে নিজের অপমান থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।

এ রকমই একটি ঘটনা ঘটেছে ফরিদগঞ্জে। হতভাগা এক তরুণীকে ২২ দিন জেল খাটতে হয়েছে। যদিও ওই তরুণীর সঙ্গে দুই দফায় অনৈতিক কর্ম করা দুইজন এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। নিজেরা বাঁচার জন্য আদালত ও থানার দ্বারস্থ হয়েছেন।

শেষপর্যন্ত ওই তরুণীর পরিবার তার পাশে দাঁড়িয়ে আদালতে ধর্ষণ ও প্রতারণা করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। এখন তারা প্রকৃত ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছেন। প্রভাবশালীদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন, তরুণীকে রক্ষা করতে রেখেছেন পর্দার অন্তরালে।

তরুণীর পক্ষের দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত দুই বৃদ্ধের মধ্যে একজন ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার পল্লী চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ ও অপরজন চাঁদপুর সদর উপজেলার সাপদি গ্রামের গ্রাম্য মাতবর জুনাব আলী তালুকদার। এছাড়া তৃতীয়জন অশ্লীল ভিডিও ধারণ ও তা দিয়ে প্রতারণার ঘটনায় অভিযুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার সুমন পাটওয়ারী।

অপরদিকে ওই তরুণীসহ কয়েকজনকে জড়িয়ে ওই দুই বৃদ্ধ ভিডিও পাইরেসি ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে চাঁদপুর মডেল ও ফরিদগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। উভয় মামলায় তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে তার নানা ও নানি এবং এর বাইরে আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

এদিকে দুটি ঘটনায় একে অপরের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা, প্রতারণা, সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো দুই বৃদ্ধের দায়ের করা মামলার ধরন ও লেখা প্রায় হুবহু। একজন অপরজনের বন্ধু। একজন তাদের বন্ধুত্বের কথা স্বীকার করলেও অপরজন অস্বীকার করেছেন।

সর্বশেষ দায়েরকৃত মামলায় একটি গণস্বাক্ষর যুক্ত করা হয়েছে। যাতে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার একজন কাউন্সিলর এবং ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে। ফলে পুরো ঘটনাটিকে জটিল করে তুলেছে। তাই এসব ঘটনার জন্য প্রকৃতপক্ষে কে দায়ী তা সঠিক তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই।

তরুণীর দায়েরকৃত মামলা সূত্র ও এলাকায় গিয়ে জানা যায়, গত ৫ বছর পূর্বে পিতা মারা যাওয়ার পর মায়ের সাথে নানার বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে বসবাস করতেন তরুণী (২০)। পরে লেখাপড়ার জন্য তিনি খালার বাড়ি হাইমচর উপজেলায় চলে যান। বর্তমানে কলেজে অধ্যয়নরত ওই তরুণী করোনার কারণে গত এক বছর ধরে নানার বাড়ি মায়ের কাছেই থাকেন।

একই বাড়ির হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ সম্পর্কে তার নানা হয়। পিতার পরিচয় সূত্র ধরে তাদের সম্পর্ক থাকলেও তার পিতার সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে আবার তরুণীর পিতার মৃত্যুর কিছু দিন পর থেকে পুনরায় যোগাযোগ শুরু হয়।

এরই মধ্যে ২০২০ সালের ৭ আগস্ট ওই তরুণীর মা বাড়িতে না থাকার সুযোগে কৌশলে আ. কুদ্দুছ রাতে ওই তরুণীর ঘরে ঢুকে নানা-নাতনির খুনশুটির একপর্যায়ে তাকে বিয়ের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। এ সময় অনৈতিক ঘটনাটি ভিডিও ধারণ করা হয়।

পরবর্তীতে ওই ভিডিও দেখিয়ে সেটি ফেরত দানের আশ্বাসে তরুণীকে চাঁদপুর সদরের নাজিরপাড়ার একটি বাসায় নিয়ে আ. কুদ্দুছের বন্ধু জুনাব আলীও গত ১৫ নভেম্বর তার সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। ওই ঘটনাটি সেখানে থাকা সুমন পাটওয়ারী তার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে। সেই ভিডিও দেখিয়ে আবার সুমন পাটওয়ারীসহ একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় নামে।

সর্বশেষ ঘটনার আলোকে জুনাব আলী বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এবং এর সঙ্গে চররাঘররায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা-নানিকে অভিযুক্ত করে চাঁদপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলাটি পরে চাঁদপুর ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ওই মামলার সূত্র ধরে গত ৪ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ তরুণী ও আতিকুর রহমান রাজুকে আটক করে। এ সময় ছয়টি মোবাইল ফোন জব্দ করে ডিবি পুলিশ। ওই মামলায় ২২ দিন জেল খাটার পর গত ২৫ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তরুণী।

অপরদিকে অপর অভিযুক্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আ. কুদ্দুছও বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এর সঙ্গে চররাঘররায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা-নানিকে অভিযুক্ত করে গত ২৪ জানুয়ারি ফরিদগঞ্জ থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলাটির বর্ণিত বিবরণ প্রায় অনুরূপ জুনাব আলীর মামলার বিবরণের মতো।

এরপর সর্বশেষ তরুণীর মা বাদী হয়ে ঘটনার সঙ্গে আ: কুদ্দুছ ও জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারীকে অভিযুক্ত করে গত ১ মার্চ চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলার বিষয়ে তরুণীর মা সাংবাদিকদের জানান, আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী আ. কুদ্দুছ তার বন্ধু জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারী আমাদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। ফলে লোকলজ্জা ভুলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার কামনা করছি।

তিনি জানান, প্রভাবশালীদের আতঙ্কে আমার মেয়েকে বর্তমানে আত্মগোপনে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তার পরিবার বর্তমানে আতঙ্কগ্রস্ত। তরুণীর মামলায় অভিযুক্ত জুনাব আলী মোবাইল ফোনে জানান, ওই তরুণী আমার স্ত্রীকে বোন বলে সংবোধন করে। সেই সূত্রে আমাকে দুলাভাই বলে ডাকতো। একদিন আমি চাঁদপুরে যাওয়ার পর সে আমাকে চাঁদপুর সদরে পাটওয়ারী বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে নিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করে। তাই আমি ওই তরুণীসহ প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এ সময় তিনি চররাঘবরায় গ্রামের হোমিও চিকিৎসক আ. কুদ্দুছকে চেনেন না বলেও জানান।

অপর অভিযুক্ত হোমিও চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ জানান, ওই কিশোরী আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে আমাকে দিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেছে। আমার সঙ্গে অনৈতিক ঘটনার ভিডিও দিয়ে আমার কাছ থেকে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। তিনি জানান, জুনাব আলী তার দোকানে আসা যাওয়ার সূত্র ধরে তাকে চিনেন ও পরিচয় রয়েছে।

চিকিৎসক আ. কুদ্দুছের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের এসআই আ. কুদ্দুস জানান, মামলার প্রধান অভিযুক্ত তরুণী ও ২নং আসামি আতিকুর রহমান রাজু জেলে থাকায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত চলছে।তিনি আরও জানান, বিচার সবার জন্য সমান। আইনকে কেউ যদি ফাঁকি দেয় তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে।

জুনাব আলীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর ডিবি পুলিশের এসআই তৌফিকুল আফসার মোবাইল ফোনে জানান, ঘটনার ব্যাপারে তিনি অনেকদূর এগিয়েছেন। শিগগিরই মামলার চার্জশিট প্রদান করা হবে।

এদিকে তরুণীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইয়্যেদুল ইসলাম বাবু জানান, জুনাব আলীর দায়েরকৃত মামলার ভিডিওচিত্র পাইরেসি করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। ভিডিওটি পাইরেসি নয়, আদালত বিষয়টি পর্যবেক্ষণে এনেছে।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, ভুক্তভোগী পরিবারটি অসহায়-নিরীহ হওয়ার কারণে তারা উল্টো জেল খেটেছে। এসব ঘটনায় প্রকৃতভাবে কারা জড়িত এবং কীভাবে সংঘটিত হচ্ছে, তার একটি সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

আরপি/ এসআই-৮



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top