রাজশাহী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় গোরস্থান

দেড় বছরেই বদলে গেল পাঁচ দশকের গোরস্থান


প্রকাশিত:
৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৩৫

আপডেট:
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৪৭

ছবি: গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় গোরস্থান

১৯৬৬ থেকে ২০২১, দীর্ঘ ৫৫ বছর। পাঁচ দশকে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার কেন্দ্রীয় গোরস্থানে কত মানুষ যে চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে গত দেড় বছরে ৩৪০ জনের ঠাঁয় হয়েছে এখানে। এদের অধিকাংশই পৌর এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। শায়িত আছেন গোরস্থানের প্রতিষ্ঠাতা গোদাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাত বারের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া মিয়া। বাবা ফাইম উদ্দিন বিশ্বাস ও মা আনোয়ারা খাতুনের পাশে শায়িত রয়েছেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক।

অন্যদের মধ্যে শায়িত রয়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শহীদুল ইসলাম। সর্বশেষ তিনি ইন্টারপোলের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও শায়িত রয়েছেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা শোয়াইবুর রহমান, গোদাগাড়ী পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নানা বয়সী মানুষ।

দীর্ঘ দিন ঘন ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ থাকা গোরস্থানে কেবল মরদেহ দাফনেই আসতেন লোকজন। প্রিয়জনদের স্মৃতিচিহ্ন টুকুও খুঁজে পেতেননা অনেকেই। দিনে দিনে মাদক সেবীদের আখড়া হয়ে উঠেছিল এলাকাটি। কিন্তু গত দেড় বছরে বদলে গেছে গোরস্তানের দৃশ্যপট। কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে ঝোঁপঝাড়। ৩১ বিঘা আয়তনের সুবিশাল গোরস্তানের চারপাশে তৈরী হয়েছে পাঁয়ে হাঁটা পথ। কিছু পথে বিছানো হয়েছে ইট। পুরো রাস্তার ধারে বসছে বৈদ্যুতিক বাতি। জানাযার জায়গাও বাঁধানো হয়েছে কনক্রিটে। ওজুখানা ছাড়াও আলাদা শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে পাশেই। এক কথায় বদলে গেছে পুরো গোরস্তানের আবহ। এমন কর্মযজ্ঞে খুশি এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরা।

ফজর কিংবা আসর, এখন গোরস্তানের জানাযার স্থানে জটলা হয় সারাক্ষণই। সেখানে বসানো কনক্রিটের চেয়ারে বসে সময় কাটান অনেকেই। গোরস্তানে আসা কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে তারা রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক ধরে হাটতেন। এই সড়কটি খুবই দুর্ঘটনা প্রবণ। হাটতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সেজন্য মহাসড়ক এড়িয়ে তারা কেন্দ্রীয় গোরস্তানে আসেন। হাটাহাটি ছাড়াও স্বজনদের কবর জিয়ারতও করেন তারা। প্রতিদিনই এমন লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে গোরস্তানে।

রোজ নিয়ম করে গোরস্তানে আসেন গোদাগাড়ী পৌর এলাকার ভগবন্তপুর মহল্লার বাসিন্দা আবু সাইদ। তিনি জানান, গত দেড় বছর ধরে তিনি গোরস্তানের ভেতরে হেঁটেছেন। মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে গোরস্তানে ঢোকেন। তবে বেশিরভাগ সময় আসেন আসর নামাজের শেষে। এই গোরস্তানে তার ছেলে শায়িত রয়েছে। গত দেড় বছরে তিনি একদিনও ছেলের কবর জিয়ারত বাদ রাখেননি।

গোরস্থান সংলগ্ন ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গোরস্তানে তার দাদা-দাদী এবং নানী শায়িত রয়েছে। তিনিও রোজ গোরস্থানে আসেন কবর জিয়ারতে। মামুন আরও জানান, ৩২ বছর আগে তার দাদা মারা গেছেন। জিয়ারত তো দূরের কথা দেড় বছর আগেও তারা কবরটি চিনতে পারতেননা। ঝোঁপ-জঙ্গল পরিষ্কার হওয়ায় এখন পুরো এলাকা ফাঁকা। দাদার কবরের পাশে গিয়ে দু-হাত তুলে দোয়া করেন।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন গোদাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া মিয়ার হাত ধরে এই গোরস্থান প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি ১ বিঘা জমি দান করে সার্বজনীন গোরস্তান গড়ে তোলেন। ইয়াহিয়া মিয়া গোরস্থান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। তার সময়কালে সাড়ে ৬ বিঘা জমি কিনে গোরস্থানের পরিধি বাড়ানো হয়।

বর্তমানে গোরস্থান পরিচালনা কমিটির সভাপতি রয়েছেন তারই ছেলে প্রথিতযথা চিকিৎসক ডা. সাইফুল ইসলাম। কাজের সূত্রে তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন। এই কমিটির সাধারন সম্পাদক মাটিকাটা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আকবর আলী। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন দেড় বছর হলো। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই সময়টা গোরস্তানের উন্নয়নে কাটানোয় সুফল পাচ্ছে এলাকাবাসী।

গোদাগাড়ী পৌর যুবলীগের সভাপতির পদেও রয়েছেন আকবর আলী। রাজনীতি এবং সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকা এই শিক্ষক বলেন, এই গোরস্তানে তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন বিশ্বাস ও মা নুরুন নেসা শায়িত রয়েছেন। শায়িত রয়েছেন ভাইসহ বহু আত্মীয় স্বজন। হয়তো তারও অন্তিম ঠিকানা হবে এখানেই। প্রতিদিন তিনি কবর জিয়ারত শেষে গোরস্তানের খুটিনাটি বিষয়ে নজর দেন।

তিনি আরও জানান, গত দেড় বছরে গোরস্থানের তিনটি ফটক, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও জঙ্গল পরিস্কার করে গোরস্তানকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। পুরো গোরস্তানকে ছয়টি ব্লকে ভাগ করে চারপাশ দিয়ে পাঁয়ে হাটা পথ তৈরী করা হয়েছে। এর মধ্যে ইট দিয়ে ৬ ফুট চওড়া রাস্তা করা হয়েছে ৫ হাজার ফুট। আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। জানাযার জায়গাটুকু কনক্রিট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। এছাড়াও পুরো গোরস্তানে আলোকায়ন হচ্ছে। সৌন্দর্য্যবর্ধনকাজও চলমান।

তিনি আরও বলেন, গত দেড় বছরে গোরস্থানের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে দান ও অনুদান থেকেই এসেছে ১৭ লাখ টাকা। এখনো গোরস্তানের অনেক কাজ বাকি উল্লেখ করে আকবর বলেন, প্রতিবছরই তারা গোরস্থানের জায়গা বাড়াচ্ছেন। এবারও ৫৭ লাখ টাকায় সাড়ে ৩ বিঘা জমি কেনা হচ্ছে। এখন জানাযা মাঠ আরো সম্প্রসারণ হবে। এক পাশে নিয়ে যাওয়া হবে অজুখানা।

প্রধান সড়ক থেকে গোরস্থানের জানাযা মাঠ পর্যন্ত ৭০০ ফুট ১০ ফুট চওড়া রাস্তা প্রয়োজন। তাছাড়া আরও ৩ হাজার ফুটের মত ৬ ফুট চওড়া রাস্তা প্রয়োজন। সরকারী বরাদ্দ পেলে তারা এসব কাজ এগিয়ে নিতে চান। ছয় মাস পর পর পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে তারা বৈঠকে কর্মপরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই নতুন রূপ পেয়েছে গোরস্থান। গোরস্থানের উন্নয়নে সবাইকে পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান সাধারণ সম্পাদক। 

 

 

আরপি/এসআর-০৩



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top