রাজশাহী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


আনন্দের সুবাতাস


প্রকাশিত:
১০ নভেম্বর ২০১৯ ০৭:৩৪

আপডেট:
১০ নভেম্বর ২০১৯ ০৭:৩৫

ছবি:লেখক

                                আনন্দের সুবাতাস
                     -ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাস। বান্দরবন জেলার রুমা থানার দায়িত্বে নিয়োজিত। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেরোসিন ফুরিয়ে যাওয়ায় হারিকেনের আলোও নিভে গিয়েছিল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি দুটা বাজে। নিঝুম রাত শুধুই নিস্তব্ধতা। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শংখনদীর পানি যেন গন্তব্যহীন অবিচল দাঁড়িয়ে। নীলাকাশে একরাশ জোস্না প্রকৃতির সিঁড়ি বেয়ে আকাশ ছুতেই ব্যস্ত। বিশাল পাহাড়গুলি অপরুপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে সাক্ষী। চারিদিকে শুধু প্রাকৃতিক নিরবতার আভাস।

বিছানা ছেড়ে অন্ধকারে টর্চের আলো না জ্বালিয়ে ধীর পদক্ষেপে সেন্ট্রি পোষ্টোর দিকে এগিয়ে যাই। অন্ধকারে গোখরা সাপের ভয় লাগছিলো। কারণ রুমা থানায় সাপের খুবই উপদ্রব। দিনের বেলাতেও থানার সব জায়গায় সাপ দেখা যায়। সেন্ট্রি পোষ্টে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি ৮টি পোষ্টের ৪টিতেই সেন্ট্রি নেই। ব্যারাক চেক করে তাদেরকে ঘুমন্ত অবস্থিায় পাওয়া যায়। সন্ধ্যা হতেই শান্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের আংশকা। যার দরুন দিনে ৪টি হলেও রাত্রিতে ৮টি সেন্ট্রি পোষ্টোর মাধ্যমে থানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। এর আগেও নাকি এখানে শান্তি বাহিনী কর্তৃক আক্রমনের চেষ্টা হয়েছিল। তারপর থেকেই সদা সতর্ক। ১০ মাস হলো আমি এ থানায় বদলী সূত্রে যোগদান করেছি।

পার্বত্য জেলায় এর আগে চাকুরী করার অভিজ্ঞতা একেবারে নেই। কিš‘ যে অভিজ্ঞতা অর্জন হলো তাতে আমি বিরক্ত এবং আতংকিত। কারণ এতে সবার জীবন বিপন্ন। যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিষয়টি থানার ডাইরীতে বিস্তারিতভাবে নোট করে পরের দিন সকাল দশটায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিছানাপত্র সহ মাঠে ফলইন শোনানো হয়। প্রত্যেকেই তাদের কৃতকর্মের জন্য বারবার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলো।


পরের দিন নির্ধারিত সময়ে সবাইকে শাস্তি স্বরূপ ব্যারাক থেকে বিছানাপত্র গুছিয়ে মাথায় করে মাঠে এনে পুনরায় ব্যারাকে নেওয়ার আদেশ শোনানো হয়। সে মোতাবেক কয়েকজন আদেশ পালনও করে। বাকিরা পালন করতেই হঠাৎ বেতার চালক দৌড়ে এসে জানান, স্যার ভাবী এইমাত্র বান্দরবন থেকে ট্রলারে রুমা থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। এনালগ টেলিফোন খারাপ থাকায় সদর থানার ও.সি বেতারের মাধ্যমে সংবাদটি জানিয়েছেন। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আমার স্ত্রী শেফালী কখন নাটোর থেকে চিটাগাং হয়ে বান্দরবনে এসেছে তা আমাকে জানায়নি।

কিছুদিন আগে সে শুধু ল্যান্ড ফোনে বলেছিলো, খুব শিঘ্রই আমাকে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দিবে। এটাই কি সেই সারপ্রাইজ? মনে মনে খুশী হই। বিয়ের পরেই হিলে পোষ্টিং হয়েছে। বৌকে নিয়ে ঘোরাই হয়নি। ভালই হলো দুজনা মিলে পাহাড়, জঙ্গল আর শংখ নদীতে ঘুরে বেড়াবো। হই হুল্লোড় আর আনন্দঘন পরিবেশে জীবনকে করবো শাশ্বত সুন্দর। অকৃত্রিম, চিরন্তন ও অনাবিল সুখের পসরা সাজিযে দু’জনাই হবো আবেগাপ্লুত। কারণ আমরা দুজনাই ভালবাসার অদৃশ্য সুতার বন্ধনে চিরকাল বাঁধা।


এ সময় বেতার চালক সবিনয়ে বলেন, স্যার, নতুন ভাবী এই প্রথমবারের মতো আমাদের মাঝে আসছেন। এ কারণে আমরা কি ক্ষমা পেতে পারি না? অন্তত: ভাবীর সৌজন্যে এ বারের মতো ক্ষমা করুন। আমরা কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে এ ধরণের ভুল আর কখনোই হবে না। ফোর্সরাও তাদেরকে সমর্থন জানায়। সঙ্গীয় অফিসারদের অনুরোধে অবশেষে সবাইকে ক্ষমা করা হয়। একে তো নতুন ভাবী আসার সুসংবাদ তদুপরি মার্জনার কথা শুনে পুরো থানায় আনন্দের সুবাতাস বয়ে যায়।


আমার স্ত্রী শেফালী রুমায় আসতে সময় লাগবে অন্ততঃ ৬/৭ ঘণ্টা এর মধ্যে তাকে বরণ করার জন্য তারা নানা ধরণের প্র¯‘তি নিতে থাকে। বাজার থেকে রঙ্গীন কাগজ এনে শোবার ঘর এবং উপরে বাসা থেকে নীচের নদীর ঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে সুন্দরভাবে সাজায়। মেসে বনমোরগ, গয়ালের (বন গরু) মাংশ এবং শঙ্খনদীর মাছ ও পোলাও রান্না হতে থাকে। বাজার থেকে তারা মিষ্টি কিনে আনে। একজন এ.এস.আই (মনছুর হাবিব) এর নেতৃত্বে ৬ জন কনষ্টেবল অস্ত্র নিয়ে থানার ট্রলারে নতুন ভাবীকে রিসিভ করার জন্য নদীপথে এগিয়ে যায়। থানা কম্পাউন্ডের চারিদিকে সাজ সাজ রব আর আনন্দের হাওয়া। নতুন ভাবীকে বরণ করার জন্য সবাই মহাব্যস্ত। এ ব্যাপারে কোথাও যেন কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত না হয় সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি। আমি বসে বসে সবই অবলোকন করে তাদেরকে নিষেধ করি। আমার কোন নিষেধই তারা শুনতেই চায় না।


অবশেষে পড়ন্ত বেলায় ট্রলারের শব্দে দূর থেকে নতুন ভাবীর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাকে বরণ করার জন্য পাহাড়ী ফুল নিয়ে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। অনুমান ১০ মিনিট পর ঘাটে ট্রলার ভিড়ে নতুন ভাবী নামা মাত্রই ফোর্সরা আনন্দে বন্দুকের গুলি ফুটিয়ে এবং পাহাড়ী ফুল দিয়ে তাকে বরন করে নেয়। নতুন ভাবী লজ্জাবনত দৃষ্টিতে ধীর পদক্ষেপে বাসায় এসে চারিদিকে এতো আয়োজন দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। এমন কি আমাকে সম্ভাষন করতেও ভুলে যায়।

অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে আড়ষ্ট হয়ে ভাবি স্ত্রীর এ ধরণের সারপ্রাইজ অতুলনীয় এবং দুর্লভ। আমি তাকে আবেগী কন্ঠে স্বাগত জানাই। এ সময় মুখে আমার এক টুকরো আনন্দের হাসি। তার দুচোখের ইশরায় আমিও খুঁজে পাই পরিশ্রান্ত মন, যেন শেষ বিকেলের ক্লান্ত পাখি ফিরেছে আপন নীড়ে। আমার সাদা মনের আঙ্গিনায় এখন শুধু সেইই। যেখানে সে শ্বেত কপোতের মতো নীলাকাশে উড়ে বেড়াবে অনন্তকাল। চাকুরীর পাশাপাশি পাহাড়, জঙ্গলে দু’জনে অনেক ঘুরেছি। কখনও ঝর্ণার পানিতে গোসল কিংবা শঙ্খ নদীতে সাঁতার কেটেছি। অনেক সময় নদীতে নৌকা ভ্রমণ এবং পাহাড়ের উপর চান্দের গাড়ীতে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছি। হারানো সেই দিনের কথা মনে পড়ে এখন শুধুই সুখাস্মৃতি অনুভব করি।

 

আজিমপুর, ঢাকা। লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা।
২৬ মে, ২০১৫

 

আরপি/ এএস



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top