আশা মনির প্রবন্ধ: বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন

ভাষা শুধু ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির জন্য শুধু ভাষার অধিকারের সংগ্রাম ছিল না, বরং এটি ছিল শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। আজ একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন এবং ভাষার পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় ভাষা আন্দোলনের চেতনায় নতুন মুল্যায়ন প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই ভাষা নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ রুখে দাঁড়ায় এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেন। তাদের আত্নত্যাগের ফলে ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই ছিলো না; এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলনও ছিলো। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে বাঙালিদের মধ্যে।
ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিলো না; এটি বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার জাগরণ ঘটায়। ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বায়ান্নোর সেই আন্দোলনই আজ আমাদের জাতীয় গৌরব, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রেভাষা।" এই ঘোষণা জনগণের মাঝে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং আন্দোলনের সূচনা হয় পরে অনেকের আত্নত্যাগের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন বিজয়ী হয়।
বাংলা ভাষা অবহেলা ও অপব্যবহার - আজ আমরা স্বাধীন হলেও বাংলা ভাষা যথাযথ ভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি? দুঃখজনকভাবে,বাংলা ভাষার চর্চায় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন।
সরকারী ও কর্পোরেট পর্যায়ে ইংরেজির আধিপত্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে, ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলার প্রতি আগ্রহ কমছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃত রুপ ('Banglish') ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করছে।
বিশ্বায়নের যুগে বিদেশি ভাষা শেখা প্রয়োজন, তবে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। বর্তমানে কনটেন্ট, সিনেমা,সংগীত এবং বিজ্ঞাপনে বিদেশি ভাষার প্রভাব এত বেশি যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলার প্রতি উদাসীনতা বাড়ছে। ভাষার এই অবহেলা ভাষা আন্দোলনের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলা ভাষা এখন ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা উইকিপিডিয়া, বাংলা কি-বোর্ড ও বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ভাষাকে আধুনিক বিশ্বের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করছে।বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষার ডিজিটাল রুপায়ণে কাজ করছে, যা ভাষার ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি শুধুমাত্র বাঙালির নয়, বরং বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪০% ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে, তাই মাতৃভাষার সংরক্ষণ আজ আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই আমাদের উচিত বাংলা ভাষার যথাযথ চর্চা,সংরক্ষণ এবং বিশ্ব দরবারে এর মর্যাদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সচেতনতা যদি না থাকে, তাহলে শহীদদের আত্নত্যাগ অর্থহীন হয়ে যাবে। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।"
ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়, কিন্তু এটি শুধু অতীতের ঘটনা নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শুধু স্মরণ নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রচলন বাড়াই।
মোছা: আশা মনি
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী
আরপি/আআ্
বিষয়: বাংলা ভাষা ভাষা আন্দোলন
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: