রাজশাহী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


‘শিবির’ করলেই কি খুন জায়েজ?


প্রকাশিত:
৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২৭

আপডেট:
৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৩০

ফাইল ছবি

ইসলামী পরিভাষায় ‘জায়েজ’ পরিভাষাটি খুব শুনি। খুব ব্যবহার করি। পরিভাষাটির ব্যাকরণগত ও তাত্ত্বিক আলোচনা বাদ দেই। সাদা কথায় বললে বুঝি- জায়েজ মানে সমর্থন। বৈধতা। কোনো কিছুকে ‘হ্যাঁ’ দেয়া। কোনো কিছুকে অনুমতি দেয়া।
এই জায়েজ শব্দটি শুধু ইসলামী পরিভাষাতেই বুঝে থাকি। ইসলামিক এ পরিভাষাটির ইংরেজি হচ্ছে ‘লিগ্যালিটি’। বাংলায় দাঁড়ায় বৈধতা, সমর্থন, অনুমতি ইত্যাদি। বৈধতাটি হতে পারে আইনগত। আবার সামাজিক বৈধতাও হতে পারে। হতে পারে শ্রুত বৈধতা। মানে, শুনে শুনেই কোনো কিছু করার বৈধতা। সামাজিকভাবে চলে আসা কোনো বৈধতাও হতে পারে। কোনো বিষয়ে রয়েছে আইনগতভাবে বৈধতা। বিপরীত শব্দ হচ্ছে না জায়েজ বা অবৈধ। মানে, কোনো বিষয়ে অনুমতি না থাকা। অবৈধ। কোনো বিষয়ে সমর্থন না থাকা।

তবে, পৃথিবীতে কিছু বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। মানে, আপনি এক শব্দে ওই বিষয়গুলোকে জায়েজ কিংবা না জায়েজ বলতে পারবেন না। এক শব্দে বৈধ কিংবা অবৈধ বলতে পারবেন না। সেগুলো নানান আলোচনায় সমাধান করা হয়।
কিন্তু ‘খুন’ কি কখনো বৈধ? কোনোভাবে বৈধ করার সুযোগ আছে? আছে। কীভাবে? ‘শিবির’ ট্যাগ লাগান। এ ট্যাগ লাগালেই খুন বৈধ। সেটা আইনগত হোক অথবা রাজনৈতিক বৈধতা। এটা বৈধ হয়ে গেছে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? কেন হবে না? হতেই হবে!

বৈধতার উজ্জ্বল প্রমাণ বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ। যাকে রোববার রাতে ক্যাম্পাসে, তার হলেই পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। ভোররাতে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গণমাধ্যমের সাহায্যে জানা গেছে, তাকে ‘শিবির সন্দেহে’ পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সে যে-ই করুক না কেন। যদিও সন্দেহের তীরটা পুরোপুরিভাবে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই। বলা বাহুল্য, এটা স্পষ্ট হয়েছে সিসি ফুটেজে। এছাড়া আবরারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি সূত্র দিচ্ছে খুনের। কারণ, সেই স্ট্যাটাসের কারণেই রোববার রাতে ছাত্রলীগ নেতারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাকে ছাত্রলীগ নেতাদের হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর, স্ট্যাম্পসহ বিভিন্নভাবে খুঁচিয়ে আহত করা হয়। ডাক্তার বলেছে, রক্তক্ষরণ ও ব্যাথায় আবরারের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় অবশ্য বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যরা পলাতক রয়েছে। আটক কিংবা শাস্তি; সেটা আমার এ প্রসঙ্গের ভিন্ন কথা। কারণ, এখানে আলোচনা করছি আটক কিংবা শাস্তির প্রাথমিক ধাপ খুন নিয়ে।

এবার বলুন, আবরারের এই খুনের বৈধতার প্রমাণ কি মিলছে? জায়েজ হয়েছে কি? হ্যাঁ! খুনের বৈধতার প্রমাণ মিলেছে! জায়েজ হয়েছে! শিবির ট্যাগ লাগিয়ে খুনের বৈধতা। যদিও সেটা আইনগত না। এটা রাজনৈতিক বৈধতা! রাজনৈতিকভাবে জায়েজ! সেটার বিচার হবে কি হবে না তা পরের কথা। বিচারটাই কাম্য।

আপনি বোধহয় খুব রাগ করছেন! এই যে বার বার বলছি ‘খুন বৈধ’ হয়েছে! হ্যাঁ, রাগ হওয়ারই কথা। কারণ খুন কি কখনো বৈধ হতে পারে? আবারও বলি বৈধ হয়েছে। জায়েজ হয়েছে! শিবির ট্যাগ লাগিয়ে কিংবা সন্দেহে বৈধতা। যদি এতে না হয়, তাহলে বৈধতার গল্প শুনুন।

খুন বৈধতার আরেকটি অন্যতম দৃষ্টান্ত ‘বিশ্বজিৎ’। বিশ্বজিৎ দাসকে ২০১২ সালে যাকে খুন করা হয়েছিল। শিবির সন্দেহে। খুনের সময় যদিও সে বার বার বলেছিল ‘আমি শিবির না, আমি শিবির করি না, আমি হিন্দু’। ক্যামেরার সামনে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। বিশ^জিৎ হত্যায় ২১ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যদিও উচ্চ আদালতে আপিলের পর ৬ জনই মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পায়। এরমধ্যে চারজনকে যাবজ্জীবন ও দুইজনকে খালাস দেয়া হয়। আর শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৩ জন আগে থেকেই পলাতক রয়েছে। যদিও এ পর্যন্ত কারো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি।

বিশ্বজিতের এ খুনটা জায়েজ হয়েছিল! ‘শিবির’ ট্যাগ লাগিয়ে খুনকে জায়েজ করেছিল! এটা আদালত কিংবা আইনগতভাবে জায়েজ ছিল বা আছে- এমন নয়। এটি রাজনৈতিকভাবে জায়েজ! রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতায় জায়েজ। তাদের লালিত ধারণায় জায়েজ!

আপনি বোধহয়, আরো রেগে যাচ্ছেন। রাগতে থাকুন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, খুনকে জায়েজ করে ফেলছি! ইনিয়ে-বিনিয়ে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খুন জায়েজ হয়ে যাচ্ছে! তাহলে শুনুন আরো কয়েকটি জায়েজ কিংবা বৈধতার গল্প।

বললে ভুল হবে না হয়তো, ভিন্ন অর্থে এ ধরণের জায়েজ প্রক্রিয়ার আতুড় ঘর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়! কি, আশ্চর্য হচ্ছেন? হতে থাকুন। আজকেই হন। আতুড় ঘর বললাম, কারণ, গত দুই থেকে তিন বছরে এ প্রকিয়ার মধ্য দিয়েই অন্তত ৮ থেকে ১০ বার ছাত্রদেরকে পেটানো হয়েছে। বিভিন্নভাবে আহত করা হয়েছে। রড, জি আই পাইপ ইত্যাদি দিয়ে পেটানো হয়েছে। পরে শিবির বলে তুলে দেয়া হয়েছে। অন্তত প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন ছাত্র এর শিকার হয়েছে। কীভাবে? ‘শিবির’ ট্যাগ লাগিয়ে। জায়েজ হয়েছে। বৈধতা পেয়েছে! হ্যাঁ, পেয়েছে। আর এর প্রত্যেকটিই একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন করেছে। যে সংগঠনই হোক। এগুলো জায়েজ খুনের প্রাথমিক ধাপ!

তাহলে জায়েজ প্রক্রিয়ার মূল কী? ‘শিবির’ ট্যাগ লাগানো। এখানে ‘শিবির’ শব্দটি রুপক এবং বাস্তব। এটা চিন্তা, কর্মে কিংবা মানসিকতায়। হতে পারে রাজনৈতিক ভিন্নতায়।

কারণ এ ভিন্নতায়, ‘শিবির’ ট্যাগের মতো ঘটনায় ২০০৯ সালের দিকে ছাত্রলীগকর্মী ফারুককে হত্যা করা হয়। এ হত্যাও একরকমভাবে জায়েজ প্রক্রিয়ার অংশ। যদিও তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী বা নেতা। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু জায়েজ খুন কিংবা খুন জায়েজের প্রক্রিয়ার ঘটনা রয়েছে এখানে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় এরকম জায়েজ প্রক্রিয়ার খবর আছে হয়তো অনেক। আছেও বটে।

তাহলে শিবির ট্যাগ, শিবির সন্দেহ, কিংবা প্রমাণিত শিবির, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কিংবা অন্যান্য সংগঠন যা-ই হোক না কেন- এটা ঘটছে একটা প্রকিয়ার মধ্য দিয়ে।
এ জায়েজ প্রকিয়াটা হচ্ছে ‘শিবির’ জাতীয় ট্যাগ প্রকিয়ার মাধ্যমে। মানে উমুক ছাত্রলীগ, উমুক শিবির কিংবা উমুক ছাত্রদল ইত্যাদি রাজনৈতিক ট্যাগ। এটা খুনকে জায়েজ করেছে! বৈধ করেছে! আইনগতভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে। দলগুলোর চিন্তা, কর্মে ও লালিত আদর্শে।

কোনো খুনই জায়েজ নয়। বৈধ নয়। হোক তা রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো। 

খুন যেকোনো দেশে, যেকোনো জায়গায় অপরাধ। সেই অপরাধের শাস্তিরও আছে বিধান। সেই শাস্তিগুলো কার্যকর হোক। তাহলেই এ জায়েজ প্রকিয়াগুলো বন্ধ হবে। যে দল বা সংগঠনই হোক না কেন। কারণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে। আগামীর বাংলাদেশ হোক এ ধরণের জায়েজ প্রক্রিয়ামুক্ত বাংলাদেশ।

 

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতক শেষ করে এখন স্নাতকোত্তর করছেন।

 

আরপি/এসআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top