রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


নির্মম অবহেলা


প্রকাশিত:
৮ নভেম্বর ২০১৯ ০২:২৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০০:২৫

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম

২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর। শীত আসি আসি করছে। পাখীর কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে সকালে জানালা খুলে বাহিরে তাকাতেই কুয়াশার আবরণ চোখে পড়ে। রাতে শিশির পড়ে থানার মাঠের ঘাসগুলো চিকচিক করে শুধু সৌন্দর্য্যই বৃদ্ধি করেনি, প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সূর্য মেঘের কোলে লজ্জাবতির মতো মুখ ঢেকে রয়েছে। লজ্জা যেন তার কাটতেই চায় না। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে নরম রোদের আলতো ছোঁয়ায় প্রকৃতি হয়ে ওঠেছে সতেজ সজীব। মৃদুমন্দ বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে কাঁপ ধরে। থানার গাছগুলির পাতা ঝরে পড়তে দেখে মনে হয় তাদের হৃদয়ে রয়েছে অনেক বিরহের বেদনা। বাইরে থানা সংলগ্ন সরষে ফুলের ক্ষেতে শুধু হলুদের সমাহার, যা দেখে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মৌমাছিরা গুণ গুণ করে গান গেয়ে সরষে ক্ষেতে মেলা বসিয়েছে। পাকা ধানের মিষ্টি গন্ধে প্রাণ সতেজ হয়ে ওঠে। শীতের আগমণে দোয়েল পাখি আর গান গায় না। অতিথি পাখীরা দলে দলে এসে ভীড় করছে। গ্রামে চলছে নতুন ধান তোলার মহা উৎসব। প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে তৈরি হচ্ছে কোন না কোন ধরণের শীতকালীন পিঠা। সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। কোমল বাতাসে মাঝে মাঝে শরীর হীম হয়ে যায়। ক্রমে রোদের উষ্ণতা কমে গিয়ে ছোট হয়ে আসছে দিনের দৈর্ঘ্য।


আমি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার ও.সি হিসেবে দ্বিতীয় বারের মতো কর্মরত। এর আগে ১৯৯২ সালেও এই থানার ও.সি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। খুব সকালে থানায় যাওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল ০৮ টার সময় থানায় আমার অফিসে গিয়ে একটি খুন মামলার কেস ডাইরী লিখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ কর্তব্যরত সেন্ট্রি এসে জানায়, একজন বৃদ্ধ লোক জরুরী ভিত্তিতে আমার সাথে দেখা করতে চান। ডাইরী লেখা বন্ধ করে ভদ্রলোককে আসার জন্য বলে অপেক্ষায় রইলাম। কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমার রুমে প্রবেশ করেন। আমি তাকে বসতে বলায় তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চেয়ার টেনে বসেন। তাকে দেখে আমি চমকে উঠি। চেহারার মধ্যে কেমন জানি একটা মলিন ভাব। বয়স ষাটোর্ধ্ব। মাথায় চুল ধবধবে সাদা অবিন্যস্ত ও উসকো খুসকো। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। চোখ ভিজা এবং লাল। বোঝা যায় এখানে আসার আগে কেঁদেছেন। পরনে পুরনো সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। পাঞ্চাবির কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। মুখ শুকনো শীতে কাঁপছেন। শরীরের গড়ন হালকা পাতলা। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা-পাকা দাঁড়ি। দেখলে মায়া লাগে।


আমি কিছু বলার আগে দু’হাত জোড় করে বলেন, স্যার। দয়া করে আমাকে মাফ করবেন। আমার কথা শোনার মতো সময় হয়তো আপনার নেই। তথাপি আপনাকে নির্ভরযোগ্য মনে হওয়ায় অনেক ভেবে চিন্তে আজ আপনার কাছে কিছু বলার জন্য এসেছি। অনেকদিন থেকে আসবো বলেও আসা হয়নি। ভেবেছি, আপনি কি বা মনে করেন। আবার না এসেও পারলাম না। আমি কৌতুহলী হয়ে নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ ছলছল করে বলেন, তার নাম জামিল, এক বেসরকারী কলেজের কেরানী ছিলেন। বছর খানেক হলো চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেওয়ার ৬ মাস পূর্বে স্ত্রী মারা যায়। একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তাকে না জানিয়ে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে আজ দু’মাস হলো ঢাকায় ফ্লাট কিনে আলাদাভাবে বসবাস করছে। মাঝে মাঝে এখানে এলেও তাকে কখনো ঢাকায় যেতে বলেনি এবং ঠিকানাও দেয়নি। একবার ঠিকানা চাওয়ায় বলে, তার স্ত্রী একজন রিটায়ার্ড জজের মেয়ে। গরীব ছাপোষা কেরানীর সাথে বসবাস এবং মেলামেশা করতে তার স্ত্রীর আত্মসম্মানে লেগে মানসম্মানের হানি হবে। তাই তাকে সেখানে যেতে বলেনা এবং ডাকেও না। সেজন্য স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকে। তাতেও তার দুঃখ নেই। দুঃখ হলো, মাস দুয়েক আগে ছেলে এবং বৌমা এসে ছলচাতুরী করে প্রতারণার মাধ্যমে তার কাছে সই নিয়ে গোপনে বাড়ীটি বিক্রি করে চলে গেছে।
আমি তাকে প্রশ্ন করি, কিভাবে জানলেন তারা বাড়ী বিক্রি করে চলে গেছে? উত্তরে জামিল সাহেব চোখের পানি মুঝে বলেন, যারা বাড়ী কিনেছেন দু’দিন হলো তারা এসে বাড়ী ছাড়ার জন্য নোটিশ করেছেন। ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেছি বসতবাড়ীটি প্রতারণামূলকভাবে ছেলে তার সই নিয়ে গোপনে বিক্রি করে দিয়েছে। নোটিশ পাওয়ার সাথে সাথে ছেলেকে অনেকবার মোবাইল করেছি। কিন্তু সে একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি বরং কিছুক্ষণ পর একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিকানাও জানিনা যে, তার কাছে যাবো। নোটিশ পাওয়ার একদিন হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর তারা দখল নিতে আসবে। বলুন তো স্যার, বাবা-দাদার এই ভিটেটুকু ছেড়ে কোথায় যাই? বাপ দাদা, স্ত্রী এমন কি ছেলেরও অনেক স্মৃতি ঐ বাড়ীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিভাবে ঐ বাড়ী ছাড়ি? তাছাড়া বাড়ীর আসবাবপত্র সহ মালামাল কোথায় সরাবো? আমার অবর্তমানে ছেলেই তো ঐ বসতবাড়ীর মালিক। অথচ সে চুপিসারে বাড়ী বিক্রি করে তাকে পথে বসিয়েছে। বলুন তো স্যার, ছেলের এই কর্মকাণ্ড কিভাবে সহ্য করি। একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে এটা করা কি তার ঠিক হয়েছে? একবারও ভাবলো না এই বুড়ো বাপটি এখন থাকবে কোথায়? শুধু কি তাই, অনেক বার চেয়েও ঢাকায় তার ফ্লাটের ঠিকানা দেয়নি। এ কথা বলার পর তিনি হু হু করে কেঁদে ফেলেন। তার কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। আমি তাকে সান্তনা দেই। তার কথা শুনে ও দুঃখ দেখে আমার চোখের পাতাও ভিজে যায়।
কিছুক্ষণ কাঁদার পর চোখ মুছে তিনি পুনরায় বলেন, নোটিশ পাওয়ার পর তিনি আশ্চর্য এবং হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলে কি করে এমন কাজটি করলো। প্রথমে তিনি বিশ্বাসই করেন নি। পরে ভূমি অফিসে গিয়ে নিজে যাঁচাই করে দেখেছেন ছেলে সত্যিই বাড়ীটি বিক্রি করে দিয়েছে। যারা কিনেছেন তারা ঐদিনই তাকে বের করে দিয়ে বাড়ীর দখল নিতো। বৃদ্ধ বলে হাত পা ধরে দু’দিন সময় নিয়েছি। স্যার, ছেলে ছাড়া তার কোন নিকট আত্মীয় স্বজন নেই যে তাদের কাছে গিয়ে থাকবেন। আর তারাই বা কয়দিন রাখবে? তাই স্যার, বাড়ীটি যাতে ফেরত পেরে পারি তো ভালো, না হলে যদি কোন বৃদ্ধাশ্রমের সন্ধান জানা থাকে তবে দয়া করে সেখানে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। এজন্যই থানায় আসা। বাকী জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিবেন জানিয়ে তিনি পুনরায় হু হু করে কেঁদে ফেলেন।
কান্নায় এক পর্যায়ে চোখ মুছে বলেন, জানেন স্যার! অভাবের সংসারে ছেলেকে খুব কষ্ট করে বড় করেছি। কোন কিছুতেই কখনো তাকে অভাব বুঝতে দেইনি। নিজেরা উপোষ থেকে সেই পয়সায় একাধিক মাষ্টার রেখে তাকে প্রাইভেট পড়িয়েছি। ছেলে খুবই মেধাবী। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে পাশ করে বুয়েটে মেধাতালিকায় ভর্তি হয়। বুয়েট থেকে পাশ করে ছেলে একটি ফার্মে মোটা বেতনে চাকুরী নেয়। সবকিছুই ঠিক ছিলো। কিন্তু বিয়ের পর থেকে পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে। অথচ তাকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম- বাকী জীবনটা সুখেই তার সাথে কাটিয়ে দিবেন। নাতী-নাতনীদের নিয়ে খেলা করবেন, তাদের সাথে গল্পগুজব করে ঘুরে বেড়াবেন, তাদেরকে আদর করবেন ইত্যাদি। অথচ সে আশা নিরাশাই থেকে গেলো। সুখ তো এলোই না বরং জীবনটা ক্রমেই দুঃখে ভরে গেল। ছেলের বিয়ের পর টাকার অভাবে স্ত্রীর চিকিৎসা ঠিকমতো করাতে পারিনি। একদিন ছেলেকে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাঠাতে বলেছিলাম। পাঠাবো বলে আর পাঠায়নি। হয়তো ভুলে গেছে কারণ একজন গরীব মায়ের কথা তার কি মনে আছে? তার মা একবার ছেলেকে বলেছিলো, বাবা! ঢাকা দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। একবারও যাওয়া হয়নি। তুই আমাকে একবার ঢাকায় নিয়ে যাস। কিন্তু দুঃখ এবং আফসোসের বিষয় একাধিকবার বলা সত্ত্বেও বেড়ানোর জন্য সে তার মাকে ঢাকা নিয়ে যায়নি। বরং নানা অজুহাত ও টালবাহানায় বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। স্ত্রীকে অভিযোগ করলে সে বলতো, থাক না। খোকা এখন ব্যস্ত। অবসর পেলে ঠিকই নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার স্ত্রীর ইচ্ছে কোনদিন পূরণ হয়নি।


স্ত্রীর অসুখ বেড়ে গেলে তাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করি। ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। এর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। হাতে কোন টাকা না থাকায় হাসপাতালের বাহিরে গিয়ে টেলিফোনে ছেলেকে বলায় সে জানায়, শশুর-শাশুড়ী এবং স্ত্রীসহ তারা পরশু এক মাসের জন্য আমেরিকায় বেড়াতে যাচ্ছে। তাই এখন সে মায়ের জন্য কোন টাকা পাঠাতে পারবে না। টাকা না পাঠাস, একবার এসে দেখে যাওয়ার জন্য বলায় ছেলে বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেয়। আমি দুঃখে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আসলে স্যার, তারই ভুল হয়েছে। তার বোঝা উচিত ছিলো যে, একজন গরীব কেরানীর স্ত্রীর জীবনের চেয়ে স্ত্রী ও শুশুর-শাশুড়ীসহ ছেলের আমেরিকায় বেড়াতে যাওয়া অনেক জরুরী এবং মূল্যবান। বৃদ্ধ হয়ে গেছি তো স্যার, এ জন্য এসব কথা মাঝে মাঝে ভুলে যাই।


বিফল মনোরথে হাসপাতালে ফিরে এলে স্ত্রী খোকার কথা জানতে চায়। আমি তাকে মিথ্যে বলে জানাই, খোকা দু’একদিনের মধ্যে এসে তোমাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাবে। শুনে স্ত্রী খুবই খুশী হয়। বলে, খোকাকে তোমরা চিন না। দেখবে ঠিকই সে এসে আমাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাবে। স্ত্রীর কথায় আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কিগো কাঁদছো? আমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলি, ঠিকই বলেছো আমাদের খোকার মতো এতো ভাল ছেলে আর হয় না। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে তার কি আহাজারি। পারলে এখনই রওয়ানা হয়। আমি বলি, বাবা তুই তোর সুবিধা মতো আয়। এ কথা শুনে স্ত্রী বলে, জানো খোকার বাবা, আমার সন্তানকে তো আমি চিনি। মায়ের জন্য তার কত চিন্তা। এ ধরণের সন্তান পেটে ধরাও গর্বের বিষয়। স্ত্রীর কথা শুনে আমি নিরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আর ভাবি আমার স্ত্রী কতবড় মিথ্যা আশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে আসা তো দূরের কথা, একটুও দুঃখ প্রকাশ করেনি। বরং টাকা পাঠানোর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। হায়রে সন্তান, মায়ের চেয়ে আমেরিকা যাওয়াই তার কাছে বড় হলো। কি চিন্তা করছো? আচমকা স্ত্রীর কথায় জামিল সাহেব সম্বিত ফিরে বলে, কই কিছু না।


৭ দিন পরও যখন খোকা এলো না তখন স্ত্রী বারবার জিজ্ঞেস করায় জামিল সাহেব কান্নাজড়িত কন্ঠে স্ত্রীকে জানান, খোকা তার স্ত্রী এবং শশুর শ্বাশুড়ী নিয়ে আজ কয়েকদিন হলো একমাসের জন্য আমেরিকা বেড়াতে গেেছ। শুনে স্ত্রী আফসোস করে চোখের পানি ফেলে বলে, ভারতে যাওয়ার জন্য টাকা নাই বা দিলো কিন্তু আমাকে একবারের জন্য দেখতে আসার সময় কি খোকার হলো না? তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, কখনো তার অযত্ন হতে দেই নি। তার সব চাহিদা মিটিয়েছি। অথচ সেই ছেলে অসুস্থতার কথা শুনে তাকে দেখতে হাসপাতালে এলো না। ছেলের এ ধরণের আচরণে তিনি খুবই কষ্ট পেয়ে কোন কথা না বলে চোখ বন্ধ করে একেবারেই নিরব হয়ে যান। এ সময় তার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। জামিল সাহেব ভাবেন স্ত্রী হয়তো ঘুমুচ্ছে। তাই তাকে আর ডিসটার্ব করেন নি।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে জামিল সাহেবের স্ত্রীকে ডেকে সাড়া না পাওয়ায় হাত ধরতেই চমকে ওঠেন। দেখেন তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। পরীক্ষা করে দেখেন তিনি মারা গেছেন। এ কথা জেনে জামিল সাহেব ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তার চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। একমাত্র সঙ্গী চিকিৎসার অভাবে তাকে ছেড়ে চিরজীবনের মতো চলে গেছে। যাওয়ার আগে ছেলে না আসার ব্যথা তার চোখে মুখে লেগে থাকতে দেখা যায়। বিদেশে ছেলের ঠিকানা না থাকায় তাকে জানানো হয়নি। আর জানালেও সে তো আসতো না। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে জামিল সাহেব চোখের পানি মুছে বলেন, স্যার আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে অযাচিভাবে অনেক ব্যক্তিগত কথা বলে ফেললাম। দয়া করে কিছু মনে করবেন না। আজ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে প্রাণ খুলে কিছু বলতে পেরে নিজেকে অনেকটাই হালকা মনে করছি। সাথে সাথে আপনার মাধ্যমে বিদগ্ধ হৃদয়ে জানাচ্ছি যে, পৃথিবীতে তার ছেলের মতো সন্তান যেন আর কারো ঘরে না জন্মায়। যে কিনা ছা পোষা গরীব কেরানী বলে বাবাকে তার বাসায় নিতে ঘৃণাবোধ করেছে। অসুস্থা মায়ের চিকিৎসা তো দুরের কথা, তাকে দেখতেও আসেনি এবং গরীব বাবার মাথা গোজার সামান্য বাড়ীটুকুও ছলচাতুরী ও প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রয়পূর্বক টাকা আত্মসাৎ করে তাকে পথে বসিয়েছে।


অসহায় জামিল সাহেবের হৃদয়স্পর্শী দুঃখের কথা শুনে তার প্রতি কেমন জানি একটা মায়া জন্মে যায়। তাকে সমস্যা সমাধানে আইনগত সহায়তা এবং বৃদ্ধাশ্রমের তথ্য শিগগির জানিয়ে সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানাই। এ কথা জানার পর জামিল সাহেব আমাকে বারবার দোওয়া করতে করতে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আমি তার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ভাবতে থাকি, আহা রে এই বৃদ্ধ বয়সে ছেলের সংসারে কোথায় আরাম আয়েশ করে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটাবেন। তা না তিনি এখন নিঃস্ব হয়ে শেষ জীবনটা কোথায় কিভাবে কাটাবেন তা নিয়েই ভাবছেন। হায়রে নিয়তি।


অফিসে বসে খুন মামলার কেস ডাইরী লেখার সময় হঠাৎ থানার সেকেন্ড অফিসার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানান, স্যার শুনেছেন। জামিল সাহেব মারা গেছেন। কোন জামিল সাহেব জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন, কেন স্যার! কিছ্ক্ষুণ আগে যে বয়স্ক ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করে গেলেন। শুনে আমি বিস্ময়ে চিৎকার করে বলি, কোথায়, কিভাবে? উত্তরে সেকেন্ড অফিসার বলেন, আপনার এখান থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে দেখেন তার বিছানা এবং জিনিসপত্র বাড়ীর গেটের বাহিরে যত্রতত্র অগোছালোভাবে পড়ে আছে। এ অবস্থা দেখে জামিল সাহেব পাশের বাড়ীর লোকজনদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন। বাড়ীর নতুন মালিক সঙ্গীয় লোকজনসহ তার জিনিসপত্র বাহিরে ফেলে বাড়ীতে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। জামিল সাহেব ভাবেন, এমন তো কথা ছিল না। তাদের কাছ থেকে তিনি ২ দিন সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু একদিন না যেতেই তার অবর্তমানে এই অবস্থা। তিনি অনেকক্ষণ নিঃশ্চুপ থেকে চারিদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তার ফেলে দেওয়া বিছানার পাশে চোখ বন্ধ করে মাথা হেলান দিয়ে বসে পড়েন। অনেকক্ষণ হলো না ওঠায় পাড়ার লোকজন এসে তাকে ডাকেন। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তার গায়ে হাত দিতেই তিনি মাটিতে গড়িয়ে পড়েন। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানান, তিনি আর নেই। অনেকক্ষণ আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।


কেস ডাইরী লেখা বাদ দিয়ে আমি নির্বাক হয়ে ভাবি, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অশীতিপর অসহায় একজন বৃদ্ধ নিজের একমাত্র ছেলে কর্তৃক প্রতারণার মাধ্যমে পৈত্রিক ভিটাটুকু হারিয়ে বাকী জীবনটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সেকি করুন আকুতি এখনও চোখের সামনে ভাসছে। আমার দু’চোখ থেকে দু’ফোটা পানি নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে। বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটি দীর্ঘশ্বাস। জামিল সাহেবকে ছেলের প্রতারণা, বাড়ী হারানোর কষ্ট এবং নির্মম অবহেলার বোঝা আর কখনো সইতে হবে না। থানার গেটে অবস্থিত চায়ের দোকান থেকে তখন একটি গানের কলি ভেসে আসছিলো“এতো সুর আর এতো গান, যদি কোন দিন থেমে যায়। সেই দিন ভুলে যাবে যে আমায়.।” আসলেও তাই, জামিল সাহেবকে সবাই ভুলে যাবে। দুঃখ তাকে মনে রাখার মতো আর কেউ রইলো না, এমন কি নিজের ছেলেও।


সাবেক পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তা

আরপি/ এআর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top