রাজশাহী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


আমাদের ‘কাদম্বিনী’


প্রকাশিত:
৬ নভেম্বর ২০১৯ ০৫:৫৫

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:২৫

ছবি: জুবায়ের বাবু

জুবায়ের বাবু:

মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী। আমাদের ‘মরিয়া’ সবকিছু প্রমাণ করতে হয়। বছরের পর বছর চলা অনাচার যেন কেউ দেখার নেই। একজন কাদম্বিনীর জন্য আমরা অপেক্ষা করি, আবার ভুলে যাই। আবার একজন কাদম্বিনী এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা চোখ কচলাতে কচলাতে আবার ভুলে যাই।


প্রথমেই আসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথায়। প্রায় ২০ বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই নানা অজুহাতে বাসার সবাইকে ম্যানেজ করে উঠলাম ভাসানী হলে। উদ্দেশ্য একটাই ছিল—স্বাধীনতা। সারাদিন বেহিসাবি চলার স্বাধীনতা, নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা, মাঝরাতে গিটারের তালে গলা ছেড়ে গান গাওয়ার স্বাধীনতা। প্রথম বর্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত হলেই থেকেছি।

‘র‌্যাগিং’ বলতে কোনও শব্দের কথা মনে পড়ছে না। কী অসাধারণ ছিল অগ্রজদের স্বাগতম। যেন পরিবারের ছোট ভাইটি প্রথম এলো আমার ঘরে। সুখ-দুঃখের ভাগাভাগিটাও ছিল একইরকম। ক্যাম্পাসজুড়ে থাকতো ছায়ার মতো। অভিযোগ অনুযোগ সব ছিল তাদের কাছে। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এক শিক্ষার্থী। র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় মো. ফয়সাল আলম নামে আরেক শিক্ষার্থী। একের পর এক র‌্যাগিংয়ের ঘটনা আসতে লাগলো বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকায়। র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় ভীত হয়ে হল ছেড়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় ক্যাম্পাসের মাঠ, সুইমিং পুল, শহীদ মিনারে। নির্ঘুম রাত কাটে খোলা আকাশের নিচে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। কিন্তু না, বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই।

ঢাকা, বরিশাল, শাহজালাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে র‌্যাগিং নামের এক মহামারী। বরিশাল আইএইচটিতে র‌্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টায় প্রমাণ করে মেয়েরাও কম যান না। বুয়েট, মেধাবীদের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংকে নিয়ে যায় শিল্পের পর্যায়ে, সেখানে ধারা-উপধারা নির্মাণ করে নির্যাতনের পরিমাণ। কী নেই সেখানে? ১৬ ব্যাচের এক ছাত্রের হাত ভেঙে দিয়েছিল এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতা অমিত সাহা। শুধু র‌্যাগিংয়ের ভয়ে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীকে। র‌্যাগিংয়ের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

দেশের কিছু মাদ্রাসায়ও শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ডেমরায় মনির হোসেন কিংবা আলমডাঙ্গার আবির হুসাইন, চট্টগ্রামে হাফেজি পড়ুয়া ছাত্র হাবিবুর রহমান, কোনও মৃত্যুই যেন টনক নড়ে না। আর সর্বশেষ কাদম্বিনী নুসরাতের কথা তো আমরা সবাই জানি।

কোথায় নেই আমাদের কাদম্বিনীরা? আছে বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাদম্বিনী।

ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতন প্রমাণেও অবিচল আমাদের কাদম্বিনী। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধর্ষিতা সেই গৃহবধূ চেয়েছিল তার সুবিচার। বিচারের আশা ছেড়ে শ্রীপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দেয় হজরত আলী এবং তার মেয়ে আয়েশা (১০)। মাত্র কিছুদিন আগে গণধর্ষণের বিচার না পেয়ে আশুলিয়ার মাহফুজা নামের এক নারী আত্মহত্যা করে। কুষ্টিয়ার আত্মহত্যাকারী ফাহিমা খাতুনের কবরটি হয়তো এখনও শুকিয়ে যায়নি। নীলফামারীর ডিমলায় ধর্ষণের বিচার না পাওয়া সেই বিধবা নারী—সবাই তো কাদম্বিনী। এই দেশে এখন বিচার চাওয়াও কি অপরাধ?

এবার আসা যাক অর্থনৈতিক কাদম্বিনীদের কথায়। যেখানে মধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে অনেকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে, সেখানেই সুনামগঞ্জের কিশোরী তানজিনা কিংবা ৫ সন্তানের জননী রহিমা খাতুন অভাবের তাড়নায় আত্মাহুতি দেয়। সন্তানের মুখে খাবার দিতে না পেরে চট্টগ্রামের মা ইয়াসমিন আক্তারও প্রমাণ করে অভাব আছে। মুখে অন্ন নয়, বিষ ঢেলেই অভাবকে স্বাগত জানায় সুনামগঞ্জের স্বামী তালুকদার ও তার স্ত্রী তৃপ্তি। গাইবান্ধার বৃদ্ধ দুলাল মিয়া, খুলনার ম্যানুয়েল মণ্ডল, টঙ্গীর বাবা আবদুল হালিম মধ্যম আয়ের দেশের আরও কত নাম। অভাবের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাকির হোসেন ছিলেন আরেক কাদম্বিনী। ১৯৯৬ সালে যখন শেয়ারবাজার লুটে নেয় লুটেরা, একের পর এক আত্মহত্যা করে শেষ সম্বল হারিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তারপর আবারও ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব ঘটিয়ে প্রায় ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ। রাজধানীর গোপীবাগের লিয়াকত আলী ও চট্টগ্রামের দিলদার হোসেন, মহিউদ্দিন শাহারিয়ার নামের কাদম্বিনীদের আত্মাহুতির পরও সুরাহা হয়নি বাজার নিয়ন্ত্রণের। মাঝে মাঝেই সর্ষের মাঝে ঢুকে পড়ে পরাক্রমশালী ভূত। যাদের তাড়াবার সাহস কারও নেই।

সবচেয়ে বেশি কাদম্বিনী আমাদের রাজনীতিতে। বিশেষ করে বিরোধী মতের বা দলের অবস্থা অনেকটা কাদম্বিনীদের মতো। রাজনৈতিক কারণে গুম খুনের সংখ্যার তো কোনও পরিসীমা নেই। বিদেশ বিভুঁইয়ে আছে লাখ লাখ নেতাকর্মী। তাদের বাড়ি আছে, কিন্তু থাকার জায়গা নেই। পরিজন আছে, কিন্তু সংসার নেই। রাজনীতিতে নির্বাচন আছে, কিন্তু ভোট নেই,নেতা আছে, কিন্তু দল নেই। পদ আছে, কিন্তু মাঠ নেই। মামলা আছে, কিন্তু অপরাধ নেই। সরকারি দল বলছে কোথাও কেউ নেই, কিন্তু বিরোধীরা বারবার মার খেয়ে প্রমাণ করছে, তারা আছে।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

 

আরপি/আআ


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top